ঝাড়গ্রাম আদিবাসী বীক্ষণকেন্দ্রের সংগ্রহশালায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
পাঁচে নেই, তিনি আছেন পাঁচ লক্ষে।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফেরার পর এটাই হল তাঁর সরকার চালানোর নীতি। মঙ্গলবার ঝাড়গ্রামে প্রথম জেলা-প্রশাসনিক বৈঠকে এমনটাই স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সরকার এমন কোনও কাজ করবে না যাতে শুধু পাঁচ জনের সুবিধা হয়। সরকারের সব সময়ের লক্ষ্য থাকবে, পাঁচ লক্ষ মানুষ সুবিধা পান, এমন সব কাজ করা।’’
এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের বক্তব্য, গত পাঁচ বছরে বিলি-বন্দোবস্তের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী যে উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছেন, সদ্যসমাপ্ত ভোটে তারা উজাড় করে সমর্থন দিয়েছে শাসক দলকে। মূলত তাদের জোরেই ২১১-এ পৌঁছে গিয়েছে তৃণমূলের আসন সংখ্যা। সমর্থকদের এই ভিত্তিকে ধরে রাখতে যে মুখ্যমন্ত্রী মরিয়া, সেটাই স্পষ্ট হয়েছে এ দিন তাঁর কথায়। মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরও ডোল বিলি করে উপভোক্তা শ্রেণি তৈরির পথ থেকে সরবেন না তিনি। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘তাঁর দ্বিতীয় পর্বও যে প্রথম পাঁচ বছরের থেকে বিশেষ আলাদা কিছু হবে না সেটা প্রশাসনিক বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
বস্তুত, আগের দফার সঙ্গে চলতি দফার ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা উল্লেখ করে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘এটা আমার প্রথম বৈঠক নয়। ১২৭তম প্রশাসনিক বৈঠক (গত পাঁচ বছরের হিসেব ধরে)। যেমন চলছে, তেমনই চলবে। কাজের সঙ্গে কাজের প্রতিযোগিতা। আরও কাজ।’’
কিন্তু নতুন কাজের কথা বলতে গিয়ে এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুরের জনপ্রতিনিধিরা তাঁর কাছে ধমকও খেয়েছেন। তাঁরা হাসপাতাল, সেতু, রাস্তার মতো পরিকাঠামো এবং বড় মাপের প্রকল্পের কথা বলতে গেলেই মুখ্যমন্ত্রী থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘নতুন কিছু চাইবেন না। যা হয়েছে তাই শেষ হোক। সবারই বাড়ির সামনে হাসপাতাল, ঘরের মধ্যে দোকান, উঠোন থেকে রাস্তা পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অর্থ সঙ্কটে এ সব এখন আর সম্ভব নয়।’’
তাঁর পক্ষে যা সম্ভব, তা-ও এ দিনের বৈঠকের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেমন, খাদ্যসচিব অনিল বর্মাকে বলেছেন, ঝাড়গ্রামে প্রত্যেক আদিবাসী যাতে রেশনের খাদ্যসামগ্রী পান, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্য সচিবদের কাছেও তাঁর বার্তা খুব স্পষ্ট, নতুন সরকারের অগ্রাধিকারের প্রথম সূচিতে থাকবে খাদ্য সুরক্ষা। থাকবে সাইকেল, কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প।
তবে অন্য দফতরের কাজকর্মের প্রতিও যে তাঁর কড়া নজর রয়েছে, তা এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। যেমন, বন দফতরের পর্যালোচনা শুরু হতেই তুমুল খেপে ওঠেন তিনি। বনকর্তারা কেন হাতির উপদ্রব ঠেকাতে পারছেন না, তার কৈফিয়ৎ তলব করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘আপনাদের কোনও প্ল্যান নেই, লজিস্টিকস নেই, মনিটরিং নেই। হাতির হানায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারেন। আমি আর এ সব বরদাস্ত করব না। বনের শূন্যপদে লোক নিয়োগ হয়েছে। তাও দু’বছরেও কেন হাতির সমস্যা মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। কারণ, আপনারা ঠিকমতো কাজ করছেন না। আপনারা দেখছি ধীরে ধীরে ‘অবজ্ঞা করা বিভাগ’-এ পরিণত হচ্ছেন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ক্রোধের মুখে পড়ে দফতরের প্রধান সচিব চন্দন সিংহ, মুখ্য বনপাল নীরজ সিংঘল (পশ্চিম চক্র)-সহ সমস্ত আধিকারিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এর আগেও আমি হাতির হানায় মৃত্যুর ঘটনা ঠেকাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার কথা বলেছিলাম। কেউ কেউ হাতি-প্রীতির কথা বলেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষেরও জীবনের দাম আছে।” এর পরেই মুখ্যসচিবকে বন দফতর ঢেলে সাজতে নির্দেশ
দেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে রেহাই পাননি গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররাও। মমতার বক্তব্য, পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এলাকার কোথায় ক’টা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, সেখানে কত শিশু ও কত জন মা যান, কত ক্লাব আছে, কতগুলো স্কুল, কতগুলোয় মিড ডে মিল চলে, ক’টা মন্দির-মসজিদ, ক’টা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে — এমন সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে। নিজের এলাকাকে হাতের তালুর মতো চিনতে হবে। যাতে কোথায় কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন একযোগে পদক্ষেপ করতে পারে। পুলিশ ও আইবি কতার্দের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, ‘‘জনসংযোগ নিবিড় করতে হবে। এলাকার সমস্ত নাগরিক সম্পর্কে খবর রাখতে হবে।’’
বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রাম, আসানসোল ও কালিম্পং জেলা তৈরির কাজ শুরু হবে। হাইকোর্টের অনুমতি পেলেই নতুন জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে ঝাড়গ্রাম।’’