সম্মতি ছিলই, শুরু হল জমি কেনা

এনটিপিসি-র নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়ে চেক নিয়ে হাসতে হাসতে বেরোচ্ছিলেন কোশিগ্রামের গোরাচাঁদ সাহা। ব্যাঙ্কের কর্মীদের কাছে চেক জমা দিয়ে তিনি বললেন, “সরকার যখন জোর করেছিল, আমরা জমি দিতে অস্বীকার করি। এনটিপিসি বোঝানোর পরে কিন্তু জমি বিক্রিতে রাজি হয়ে গিয়েছি।”

Advertisement

সৌমেন দত্ত

কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:১২
Share:

চেক হাতে জমিদাতারা। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

এনটিপিসি-র নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়ে চেক নিয়ে হাসতে হাসতে বেরোচ্ছিলেন কোশিগ্রামের গোরাচাঁদ সাহা। ব্যাঙ্কের কর্মীদের কাছে চেক জমা দিয়ে তিনি বললেন, “সরকার যখন জোর করেছিল, আমরা জমি দিতে অস্বীকার করি। এনটিপিসি বোঝানোর পরে কিন্তু জমি বিক্রিতে রাজি হয়ে গিয়েছি।”

সিঙ্গুরের সঙ্গে এখানেই ফারাক হয়ে গেল কাটোয়ার। শিল্পের নামে জোর করে আবাদি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেই জোট বেঁধেছিলেন সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিরা। বাম আমলে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে কাটোয়াতেও বাধা আসে। কিন্তু রাজ্যে সরকার বদলের পরে জাতীয় সংস্থা এনটিপিসি সকলের আগাম সম্মতি নিয়ে সরাসরি জমি কিনতে নামে। বদলে যায় পরিস্থিতি।

Advertisement

দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে শুক্রবার থেকেই আনুষ্ঠনিক ভাবে জমি কিনতে শুরু করল এনটিপিসি। প্রথম দিনের জন্য তালিকাভুক্ত চাষিদের সকলেই জমি বিক্রি করে চেক নিয়ে গিয়েছেন।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন ১০৫ জন চাষির কাছ থেকে ১০.৮৮ একর জমি কেনা হয়েছে। প্রায় সওয়া দু’কোটি টাকার চেক বিলি হয়েছে। আপাতত ঠিক হয়েছে, আগামী ৩০ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ের বাকি ১৭ একর জমি কেনা হবে। প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার অভিজিৎ সেন বলেন, “জমি কেনা শুরু হল। ধীরে ধীরে প্রস্তাবিত সব জমি কেনা হবে।”

প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এনটিপিসি চুরপুনি, কোশিগ্রাম ও শ্রীখণ্ড মৌজার ১৪২৮ জন জমির মালিকের থেকে ১৯৭ একর জমি কিনবে। বাম আমলে অধিগৃহীত জমি ঘেরা কাঁটাতারের বেড়ার ঠিক পাশের জমিগুলি এ দিন কেনা হয়। চুরপুনি গ্রামের যুবক উজ্জ্বল গুপ্তের মতে, “জমি দেওয়ার জন্য লোকে মুখিয়ে রয়েছে। এনটিপিসি-ই তাড়াতাড়ি জমি নিতে পারছে না।”

চাষিদের মধ্যে এ ভাবে জমি বিক্রি করার হিড়িক কেন?

জমিমালিক গদাধর সাহার ব্যাখ্যা, “আমরা এক সময়ে জমি দেব না বলে আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু এখন ধানের দাম নেই। চাষ করে লোকসান হচ্ছে। জমি বিক্রি করে উপযুক্ত দাম পাচ্ছি বলে এই সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চাইনি।” চুরপুনি গ্রামের তপন ঘোষালও বলেন, “বাপ-ঠাকুর্দার জমি বিক্রি করতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তব বুঝলে জমি আঁকড়ে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।”

এ দিন সকাল থেকেই শ্রীখণ্ডে সংস্থার ফিল্ড অফিসে ছিল সাজো-সাজো রব। বেলা ১২টা থেকেই জমি মালিকেরা নথিপত্র নিয়ে হাজির হয়ে যান। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা শিবির করে বসেন। বেলা আড়াইটে নাগাদ জমির দাম বাবদ চেক দেওয়া শুরু হয়ে যায়। চেক নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে রেজিস্ট্রি করেন জমির মালিকেরা। বিএলএলআরও দফতর খাজানা আদায়ের শিবির বসিয়েছিল। যে সব চাষির খাজনা বাকি ছিল, জমি বিক্রির আগে তাঁরা তা মিটিয়ে দেন।

চুরপুনি গ্রামের অজিত গুপ্ত, সুরজিৎ গুপ্তরা বলেন, “জমি তো দিলাম, এ বার আমরা চাই, প্রকল্প দ্রুত শেষ হোক।”

এই দিনটাতে পৌঁছতে অবশ্য এনটিপিসি-কে কম পরিশ্রম করতে হয়নি। ক্ষমতায় এসেই যখম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দিলেন, তাঁরা শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দেবেন না, শিল্প সংস্থাকেই জমি কিনে নিতে হবে, এনটিপিসি কর্তাদের মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল। এর আগে দেশে এত প্রকল্প হয়েছে, কখনও জমি কিনতে নামতে হয়নি জাতীয় বিদ্যুৎ সংস্থাটিকে। শেষমেশ তাতেই রাজি হন সংস্থা কর্তৃপক্ষ।

২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর কাটোয়ায় দফতর খোলা হয়। আশপাশের গ্রামে-গ্রামে ঘুরে চাষিদের বোঝাতে শুরু করেন সংস্থার অফিসারেরা। একটি গ্রামে গিয়ে তো তাড়াও খেতে হয়েছিল তাঁদের। তবু তাঁরা দমেননি। বরং গ্রামের মানুষদের নিয়ে বসে প্রকল্প হলে এলাকায় কী কী উন্নতি হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। গৃহবধূদের কম্পিউটার শিক্ষা দিয়েছেন। তার পরেও দরকারি জমির পুরোটা পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই অবস্থায় রাজ্য ১০০ একর সরকারি জমি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে, আর তার পরেই জট কেটে যায়। এনটিপিসি-র এক শীর্ষকর্তা বলেন, “কথাতেই আছে, ইচ্ছা থাকলে উপায় ঠিকই হয়। প্রত্যেকের ইচ্ছার জোরেই কাটোয়ার এই বিদ্যুৎ প্রকল্প এ দিন প্রথম সত্যি করে পা ফেলল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন