পানাগড় জট

ক্ষতিপূরণ চাই না, রাস্তা হোক জমি ছাড়তে রাজি দোকানিরা

পুনর্বাসন নয়। এমনকী, ক্ষতিপূরণের দাবিও উঠল না! অর্থনীতির সহজ নিয়ম মেনেই অবশেষে পিছু হটলেন জাতীয় সড়কের দু’ধার জবরদখল করে থাকা ব্যবসায়ীরা। আর তার ফলে প্রায় দেড় দশক বাদে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পানাগড় বাজার অংশের যান-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

Advertisement

সুব্রত সীট

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:১২
Share:

পুনর্বাসন নয়। এমনকী, ক্ষতিপূরণের দাবিও উঠল না! অর্থনীতির সহজ নিয়ম মেনেই অবশেষে পিছু হটলেন জাতীয় সড়কের দু’ধার জবরদখল করে থাকা ব্যবসায়ীরা। আর তার ফলে প্রায় দেড় দশক বাদে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পানাগড় বাজার অংশের যান-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

Advertisement

অভিজ্ঞতা বলে, চার লেনের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের যাবতীয় গতি আটকে যায় পানাগড় গিঁটে। যানজট, দীর্ঘ অপেক্ষা, দুর্ঘটনা নিত্য ঘটনা। কিন্তু, এত দিন দার্জিলিং মোড় থেকে পানাগড় বাজারের ওই সওয়া তিন কিলোমিটার রাস্তা দু’লেন থেকে চার লেন করার কাজে রাজি ছিলেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। দোকান ভাঙা পড়ার আশঙ্কায় বারবার রাস্তা সম্প্রসারণে বাধা দিয়েছেন তাঁরা। বরং দিনের পর দিন তাঁদের দোকানের পসরা উপচে পড়েছে রাস্তায়। আর জবরদখলের জেরে আরও সঙ্কীর্ণ হয়েছে জাতীয় সড়ক। সেই ব্যবসায়ীরাই এ বার অনড় মনোভাব ছেড়ে রাস্তার দু’পাশে ২০ ফুট করে জায়গা ছাড়তে রাজি হয়ে গেলেন!

বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন জানিয়েছেন, পানাগড় বাজারের ভিতরে জাতীয় সড়কের দু’পাশে অনেকটা সরকারি জায়গা পড়ে রয়েছে। জবরদখল করে অনেকে ব্যবসা করছেন। এ বার ওই অংশের রাস্তা সংস্কার ও সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। রাজ্যের মুখ্যসচিব তাঁকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। শনিবার বিকেলে জেলাশাসকের পৌরোহিত্যে কাঁকসা ব্লক অফিসে পানাগড়ের ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এ নিয়ে। দু’এক দিনের মধ্যেই মাপজোক এবং প্রাথমিক কাজকর্ম শুরুর আশ্বাসও দিয়েছেন জেলাশাসক। অথচ ঘটনা হল, কিছু দিন আগে খোদ মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রই শিল্পপতিদের সঙ্গে এক বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, খাসজমি থেকে জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা যাবে না। বরং তাঁদের স্বীকৃতি দিয়ে পুনর্বাসনের বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দেবে রাজ্য।

Advertisement

পানাগড়ের ক্ষেত্রে কিন্তু পুর্নবাসন ও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা জমি দিতে রাজি হয়েছেন বলে প্রশাসনের দাবি। কেন এই উলটপুরাণ?

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

এর পিছনে রয়েছে অর্থনীতির সহজ অঙ্ক। ২০০১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বর্ণ চতুষ্টয় জাতীয় সড়ক প্রকল্পে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক চার লেন করার কাজ শুরু হয়। পানাগড় থেকে বরাকর এবং পানাগড় থেকে ডানকুনি পর্যন্ত নির্মাণ কাজ যথাসময়ে শেষ হলেও দোকান-বাজার ভাঙা পড়ার আশঙ্কায় পানাগড়ের ভিতরে সওয়া তিন কিলোমিটার রাস্তায় হাত দিতে দেননি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। হাইকোর্টও জিটি রোড দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সংঘাতের আশঙ্কায় সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত করেনি রাজ্য সরকার। আর সেই সুযোগে দার্জিলিং মোড় থেকে রেল সেতু পর্যন্ত পানাগড় বাজারের রাস্তার হাল আরও শোচনীয় হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়। বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ জনের প্রাণহানিও ঘটে। সমস্যার সমাধানে ২০১০ সালে বাইপাস তৈরির সিদ্ধান্ত নেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, সেনার অনুমতি না মেলায় দীর্ঘদিন বাইপাসের কাজ শুরু করা যায়নি। শেষ অবধি ২০১৩ সালে জমির মাপজোক শুরু হয়। আর গত বছর থেকে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাইপাস তৈরির কাজ শুরু হয়। কয়েক মাসের মধ্যে বাইপাসের এক দিক খুলে যান চলাচল শুরু হয়ে যাওয়ারও কথা।

আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পানাগড় বাজারে রাস্তা দখল করে থাকা ব্যবসায়ীরা। ফল বিক্রেতা শ্রীরাম সাউ স্পষ্টই বলে দিচ্ছেন, ‘‘বাইপাস হয়ে গেলে বাজারের রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা এক ধাক্কায় কমে যাবে। আর আমাদের রাস্তা দিয়ে বাস-গাড়ি না গেলে ক্রেতাই তো পাব না! কারণ সারা দিনই পানাগড়ে নেমে বাস ধরার জন্য বা স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনেকে আসেন। ক্রেতার একটা বড় অংশ তাঁরাই।’’ যানজট দ্রুত মেটাতে না পারলে আখেরে যে তাঁদেরই ক্ষতি, তা মেনে নিয়ে আর এক ব্যবসায়ী জিতেন্দ্র সিংহ বলছেন, ‘‘শুরুতে সমস্যাটা এমন ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাস-গাড়ি বেড়েছে বহু গুণ। এখন রাস্তার হাল না ফিরলে বহু ক্রেতা হারাব। তাঁরা বাইপাস দিয়ে যাতায়াত করাই পছন্দ করবেন। এত দিন সমস্যাটা বুঝতে পারিনি।’’ তাঁরা স্থানীয় বুদবুদ বাজারের উদাহরণও দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, বুদবুদে বাইপাস নির্মাণের পরে বাজারের ভিতর দিয়ে সাধারণ যানবাহন তো দূরের কথা, বাস চলাচলও একপ্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। রাস্তা চওড়া না হলে গাড়ির সংখ্যা বাড়লে পানাগড় বাজারের ভবিষ্যৎও সে দিকেই এগোবে বলে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা।

আশঙ্কায় রয়েছে জেলা প্রশাসনও। সূত্রের খবর, বাইপাসের সৌজন্যে পানাগড়ের ভিতর দিয়ে যানবাহন চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে গেলে গুটিয়েই যাবে ওই বাজার। যার বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ একশো কোটির কাছাকাছি। আর বাজার গুটিয়ে গেলে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাবে সরকারও। ব্যবসায়ীদেরও দাবি, বাজারের ভিতরের রাস্তা ভাল হলে ৮ কিমি দীর্ঘ বাইপাস এড়িয়ে বাস ও গাড়িগুলি আগের মতোই এই সওয়া তিন কিলোমিটারের অংশ ব্যবহার করবে। ফলে বাজারের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না। পানাগড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির তরফে মতিম খান জানান, তাঁরা সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন।

জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী যে অংশের জন্য বাইপাস (ডাইভারশান), সে অংশের দায়িত্ব (এ ক্ষেত্রে পানাগড় বাজার) সংশ্লিষ্ট রাজ্যের। তারা চাইলে ওই রাস্তা চওড়া করতেই পারে। জেলাশাসক জানান, বর্তমান সড়কের দু’পাশে আরও ২০ ফুট করে রাস্তা পাকা করা হবে। রাস্তায় ডিভাইডার দিয়ে আলোর ব্যবস্থা হবে। বর্ধমান জেলা পরিষদের সদস্য দেবদাস বক্সী বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীরা সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভোল বদলে যাবে। ট্রাফিকও গতি পাবে।’’ ওই রাস্তায় নিত্য যাতায়াতকারীদের কটাক্ষ, ব্যবসায়ী ও সরকারের এই উপলব্ধি হতেই পেরিয়ে গেল কতগুলো বছর!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement