বাতিল নোটে আপত্তি বাড়ছে, ধুঁকছে বাজার

বিকেল ৩টে, কোলে মার্কেটের পাইকারি বাজার। দুই ঝুড়ি সবুজ, টাটকা লাউ নিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে হুগলির চাষি বনমালী ঘোষ। অন্য সময়ে টাটকা সবজি বেচতে বড়জোর এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।

Advertisement

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

বিকেল ৩টে, কোলে মার্কেটের পাইকারি বাজার। দুই ঝুড়ি সবুজ, টাটকা লাউ নিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে হুগলির চাষি বনমালী ঘোষ। অন্য সময়ে টাটকা সবজি বেচতে বড়জোর এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। বৃহস্পতিবার সেখানে তিন ঘণ্টা পেরিয়েও খান চল্লিশ লাউ রয়ে গিয়েছে ঝুড়িতে। বনমালীবাবু জানালেন, এমনিতেই শীতের আগে অকাল বৃষ্টিতে সব্জি চাষের ক্ষতি হয়েছে। আর তার পরেই ৫০০-১০০০ টাকার নোট নিয়ে সমস্যায় বেচাকেনা শিকেয়। ‘‘তাই ১০০ টাকার নোটের পাশাপাশি বাধ্য হয়ে কিছু অচল টাকাও নিচ্ছি। না হলে মাল বিক্রি করতে পারব না।’’ এর পরে ওই টাকা নিয়ে কী হবে, তা অবশ্য জানেন না বনমালীবাবু।

Advertisement

তারকেশ্বর লাইন থেকে বড় এক ঝুড়ি সিম নিয়ে এসেছিলেন স্বপন মণ্ডল। সিমের এখন ভালই চাহিদা। কিন্তু পুরো মাল বিক্রি করতে হলে ৫০০-১০০০ টাকার নোট নিতে হবে। অগত্যা যাঁরা বেশি মাল যাঁরা কিনছেন, তাঁদের থেকে অচল টাকা নিয়েছেন স্বপনবাবুও। ওই টাকা পরে কৃষি সমবায় ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তবে দুই বিক্রেতাই জানিয়ে দিয়েছেন, এর পর থেকে আর পুরনো টাকা নেবেন না তাঁরা। কারণ পুরনো টাকা জমা দেওয়া বা তোলার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কে এত রকম বিধি-নিষেধ তৈরি হচ্ছে, তাতে পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়ার মতো সাহস আর তাদের নেই। তার জন্য যদি দু-এক দিন ব্যবসা বন্ধ রাখতেও হয়, তাতেও রাজি তাঁরা।

Advertisement

পরিমাণে কম হলেও অচল টাকা এখনও সচল পাইকারি বাজারে। তবে এখনও ওই নোট নেওয়ার লোকের সংখ্যাটা দ্রুত কমে আসছে। খুচরো ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা আজ, শুক্রবার থেকে সব্জি ও মাছের পাইকারি বাজারে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পাইকারি এবং খুচরো বাজারে ব্যাপক ভাবে ব্যবসা মার খেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

ইতিমধ্যেই পুরনো টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ডায়মন্ড হারবার বাজার। অচল নোটে সমস্ত ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে হাড়োয়ায় পাইকারি মাছবাজার ৫০০-১০০০ টাকার নোট নিতে অস্বীকার করেছে। খুচরো ব্যবসায়ীরা এ দিন সকালে হাড়োয়ায় গিয়ে মাছ কিনতে পারেননি। শিয়ালদহ বাজারের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীদের একাংশ এ দিন খুচরো ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দিয়েছেন, আজ, শুক্রবার থেকে তাঁরাও আর অচল টাকা নেবেন না। কারণ, ছোট-মাঝারি বহু পাইকারের ঘরেই গত কয়েক দিনে দুই-আড়াই লক্ষ পুরনো টাকা জমে গিয়েছে। সেই টাকার অঙ্ক আরও বাড়লে এর পরে বিভিন্ন জায়গায় কৈফিয়ত দিতে হতে পারে। ফলে পুরনো টাকায় আর কোনও লেনদেন না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই পাইকারি ব্যবসায়ী।

একই ছবি ছিল পাতিপুকুর পাইকারি বাজারেও। সেখানকার মাছ ব্যবসায়ীদের সভাপতি কমল দাস জানান, খুচরো ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এখনও কিছু ৫০০ টাকার নোট নেওয়া হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি যা, তাতে পুরনো নোট আর নেওয়া যাবে না বলেই জানিয়েছেন তিনি। টাকার লেনদেন কমে যাওয়ায় মাছের আমদানিও কমে গিয়েছে বলে কমলবাবুর দাবি। হাওড়া পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীদের তরফে সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ জানিয়ে দেন, ক্ষতির বহর বাড়লেও তাঁরা কিছুতেই আর ৫০০-১০০০ টাকার নোট নেবেন না। ফলে চালু টাকাতেই মাছ কিনতে হচ্ছে খুচরো ব্যবসায়ীদের।

পাইকারি বাজারগুলির এই সিদ্ধান্তে আরও ধুঁকছে কলকাতার খুচরো বাজারগুলি। এ দিন টালা থেকে টালিগঞ্জ, সব্জি থেকে মাছের প্রতিটি বাজারেই খদ্দের ছিল হাতে গোনা। কিছু কিছু বাজার কার্যত বন্‌ধের চেহারা নেয়। মাছের বাজারে ছিল না চেনা হট্টগোল। মুরগির দোকানে দু-এক জন খদ্দেরের দেখা মিললেও কার্যত মাছি তাড়িয়েছে খাসি মাংসের দোকান। টাকার জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে খুচরো ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন।

অনেকে ভেবেছিলেন, নোট বাতিলের জেরে এ বার জিনিসের দাম কমবে। তার প্রতিফলন অবশ্য বাজারে এখনও সে ভাবে পড়েনি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলোর মতো কিছু সব্জির পাশাপাশি কিছু মাছের দাম খানিক কমলেও বাকি জিনিসের দামে তেমন হেরফের নজরে পড়েনি।

সমস্যায় দমদম, মানিকতলা, সল্টলেক, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট বাজারের সব্জি বিক্রেতারাও। পুরনো নোটে লেনদেনে পাইকার বা চাষিদের অধিকাংশই আর রাজি না হওয়ায় মাল কিনতে পারছেন না তাঁরা। অন্য সময়ে সব ধরনের সব্জি মিলিয়ে ২০ কেজি মালের জায়গায় এখন কেনা হচ্ছে চার কেজি। সংসার চালিয়ে পকেটে যতটুকু টাকা থাকছে, সেটুকু দিয়েই আপাতত দোকান খুলছেন ওই বিক্রেতারা। আশঙ্কায় আছেন, টাকার টানাটানি আর বাড়লে দোকান বন্ধ রাখতে হবে।

কোলে মার্কেট পাইকারি বাজারের তরফে উত্তম মুখোপাধ্যায় জানান, বৃহস্পতিবারও কিছু ব্যবসায়ী পুরনো নোট নিয়েছেন। কিন্তু তাঁরাও বোধহয় আর নিতে পারবেন না। কারণ, ইতিমধ্যে চাষিরাও আতঙ্কে পুরনো নোট নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে পাইকাররাও তাঁদের থেকে মাল কিনতে পারছেন না। উত্তমবাবু জানান, গত কয়েক দিনে কোলে মার্কেটের ব্যবসা এক চতুর্থাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে কিছু ব্যবসায়ীর হাতে ২০০০ টাকার নোট আসায় এ দিন বাজারে তবু কিছু খদ্দের এসেছিলেন বলে তাঁর দাবি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement