নীরেনদা শুধুমাত্র বাংলা কবিতার জগতে নন, বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রেও এক জন অপরিহার্য মানুষ। আজ বাংলা ভাষার যে লিখিত প্রামাণ্য রূপ, তার অনেকটাই কিন্তু আড়াল থেকে মেজেঘষে তৈরি করে দিয়েছেন নীরেনদা। বানান কী হবে আর বাক্যের গঠনে যতিচিহ্নই বা কোথায় বসলে ভাল হয়, এ বিষয়ে নীরেনদার দেখানো পথ আমরা আজও অনুসরণ করছি।
কিন্তু এ সমস্ত কিছুর চাইতে নীরেনদা আমার জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন সেই ক্লাস সেভেনে। পাঠ্যক্রমের বাইরে সেই প্রথম আমি যে মানুষটির কাব্য সঙ্কলন পড়ি বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়ে, সেই কবির নাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সেই অর্থে বলতে গেলে, নীরেনদার লেখাই কিন্তু আমাকে কবিতার নেশা ধরায়। পয়সা জমিয়ে আমি একের পর এক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার বই কিনতে শুরু করি। সেই পাঠের বিস্ময় আজও নিজের কাঁধে বহন করে চলেছি।
পরে যখন আলাপ করবার সৌভাগ্য হয়েছে, তখন কী আশ্চর্য স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, ভাবতেই অবাক লাগে! মনে পড়ে, আমার আর দূর্বার বিয়েতে এসেছিলেন উনি। কোনও রকম উপহার আনা বারণ ছিল বলে নিজের সাম্প্রতিকতম কবিতার বইটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আজ বুঝতে পারি, ওর চাইতে দামি উপহার আমরা আর পাইনি।
আরও পড়ুন: রোদ্দুর হয়ে গেলেন অমলকান্তির কবি নীরেন্দ্রনাথ (১৯২৪-২০১৮)
নীরেনদার কবিতা বরাবর তাঁর মতোই ঋজু, স্পষ্টভাষী ও গভীর। সে নিয়ে বাক্য ব্যয় করা আমার সাজে না। বরং বলতে পারি, চার পাশের এই অহমিকার রাংতা-মোড়া পরিবেশে নীরেনদা ছিলেন এক জন অন্য গ্রহের মানুষ। উচ্চকিত বা উত্তেজিত না হয়েও যে স্পষ্টভাষী হয়ে ওঠা যায়, নীরেনদাকে দেখেই তা শিখেছি। অত বড় মাপের এক জন কবি এবং পণ্ডিত অথচ তাঁর চালচলনে কোনও দিন সে সবের এতটুকু প্রকাশ দেখিনি। বটবৃক্ষের মতো ওই মানুষটির কাছ থেকে সমস্ত কিছুই ছিল শিখে নেওয়ার।
আরও পড়ুন: সৌজন্য-সম্ভ্রমের প্রকাশ দ্বিজেনদা
আর সব শেষে বলি, দেখা হলে কাঁধে হাত রেখে সব সময় নীরেনদা একটা নিরুচ্চার হাসি হাসতেন। সেই হাসির দাম আবহমান বাংলা কবিতাও মেটাতে পারবে না।