Infiltrators Flee Back

কাঁটাতারের বেড়া পেরোতে চেয়ে নামহীন, রাষ্ট্রহীন মানবস্রোত জড়ো হচ্ছে হাকিমপুরে! থানায় ঠাঁই নেই, নেই খাওয়ার সংস্থান

হাকিমপুর বাজারে কামরুল গাজির হোটেলে বিক্রিবাটা বেড়েছে। বেলা সাড়ে ১২টা বাজলেই তিনি সাইকেলের হাতলে বড় বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে বিএসএফের গেট পেরিয়ে চলে আসছেন বাংলাদেশিদের অস্থায়ী শিবিরগুলির সামনে। আজ প্রথম কিস্তি।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ১০:০১
Share:

হাকিমপুর চেকপোস্টের সামনে অপেক্ষায় কেটে যাচ্ছে দিন-রাত। তার ফাঁকেই ক্ষুধানিবৃত্তি। স্থানীয় হোটেলমালিকের কাছ থেকে দুপুরের খাবার কিনছেন অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি যুবক। —নিজস্ব চিত্র।

বাচ্চু সর্দারের কথা শোনার পর ফিরতে হল বিএসএফের চেকপোস্টে।

Advertisement

চেকপোস্টের বাইরে থেকেই যে বসিরহাটগামী বাস ছাড়ে, সেই ডিএন-১৩ বাসের কন্ডাক্টর বাচ্চু। রোজ কয়েক ঘণ্টা করে কাটাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারীদের জমায়েতের মাঝে। ফিসফিস করে তিনি বললেন, ‘‘বিএসএফ নিজেই তো কয়েক জনকে বাংলাদেশে ফিরতে দেয়নি।’’ কিন্তু তাঁরা কোথায়? বাচ্চু বললেন, ‘‘তারা এখানে এখন আর নেই। যেখানে থাকছিল, সেখানেই ফেরত যেতে বলেছে।’‍’ কেন? তাঁরা কারা? বাচ্চুর জবাব, ‘‘ওরা হিন্দু। সব মিলিয়ে এই ক’দিনে ১০-১২ জন এসেছিল। বাংলাদেশ ফিরে যেতে চাইছিল। বিএসএফ ফিরতে দেয়নি।’’

কাদের বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে আর কাদের বেছে বেছে থেকে যেতে বলা হচ্ছে? এ প্রশ্ন সরাসরি করলে জবাব তো মিলবেই না। কথোপকথনেও ইতি। অতএব পুশব্যাকের নিয়মকানুনের প্রসঙ্গ তোলা গেল। কিন্তু সেই আলাপচারিতায় ‘এসআইআর’ শব্দবন্ধ উচ্চারিত হতেই সতর্ক হাকিমপুর চেকপোস্টে কর্তব্যরত বিএসএফ আধিকারিক। শুধু বললেন, ‘‘রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনও লেনদেন নেই। যা নির্দেশ আসে, সেটুকুই করি।’’ নির্দেশ কার? একটু থেমে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রৌঢ় সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, ‘‘সবই তো জানেন। আমাদের কাছে নির্দেশ এলে তো (কেন্দ্রীয়) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকেই আসবে।’’

Advertisement

অপেক্ষার প্রহর। বিএসএফ চেকপোস্টের বাইরে অনুপ্রবেশকারীদের অপেক্ষা। —নিজস্ব চিত্র।

তবে নির্দেশটা ঠিক কী, সে প্রসঙ্গে এগোতে চাইলেন না চেকপোস্টে কর্তব্যরতরা। বলছেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশ তো আমাদের কাছে আসে না। আসে উপরওয়ালাদের কাছে। আমাদের শুধু বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা সেটুকুই করছি।’’

পুলিশ কী করছে? স্বরূপনগর থানার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় রাস্তায় রোজ বসে থাকছেন শ’য়ে শ’য়ে অনুপ্রবেশকারী। তাঁর নিজেরাই নিজেদের ‘অবৈধ’ বলে স্বীকার করছেন। পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে না কেন?

থানায় গিয়ে পাওয়া গেল না ওসি অরিন্দম হালদারকে। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ায় মহিলা কনস্টেবল বসিয়ে রেখে গেলেন অফিসারের খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে সাদা পোশাকের এক আধিকারিক এলেন। তিনিই ডিউটি অফিসার কি না, স্পষ্ট বললেন না। নাম-পরিচয় বলে অনুরোধ করলেন নাম না প্রকাশ করতে। তাঁর বক্তব্য, হাকিমপুরে অনুপ্রবেশকারীদের স্রোত শুরু হওয়ার পরে প্রথম দু’দিন বিএসএফ তাঁদের আটক করেছিল। তার পরে পুলিশের হাতে তুলেও দিয়েছিল। কিন্তু দু’দিনে ৯৫ জন কয়েদিকে হেফাজতে নিয়ে স্বরূপনগর থানার নাভিশ্বাস উঠে যায়। এত জনকে একসঙ্গে রাখার পরিকাঠামো সাধারণত কোনও থানাতেই থাকে না। ফলে প্রথম সমস্যা হয় স্থান সঙ্কুলানের। দ্বিতীয়, এত জনের খাওয়াদাওয়ার। বিষয়টি ব্যয়সাপেক্ষে।

বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার তালিকায় মহিলা ও শিশুদের সংখ্যাও কম নয়। —নিজস্ব চিত্র। —নিজস্ব চিত্র।

স্থান সঙ্কুলান নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল বসিরহাট আদালতকেও। এমনকি, বসিরহাট সংশোধনাগারও আচমকা কয়েদির স্রোতে আতান্তরে পড়ে গিয়েছিল বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। অতএব প্রথম দু’দিন ধৃতের সংখ্যা দেখে নেওয়ার পরে পুলিশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘আমরা আপাতত ওদিকে তাকাচ্ছি না।’’ পুলিশ সূত্রও বিএসএফের মতোই ‘উপরমহলের নির্দেশ’-এর কথা শোনাচ্ছে।

বিএসএফ অবশ্য সব দিকে তাকাচ্ছে। চেকপোস্ট থেকে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৩০০ মিটার দূরে দূরে অপেক্ষারত জমায়েতে কখন, কে, কী খাবার দিয়ে যাচ্ছে, সে দিকেও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তীক্ষ্ণ নজর। টানা তিন-চারদিন ধরে খোলা আকাশের নীচে সকলকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দেখে ‘মানবিক আয়োজন’ করেছিলেন তৃণমূল যুবর ব্লক সভাপতি ইমরান গাজি। স্থানীয় ক্লাবকে সঙ্গে নিয়ে, অল্পবিস্তর চাঁদার ব্যবস্থা করে রাতে খিচুড়ি রেঁধে বিতরণ করা হচ্ছিল জমায়েতে। দিনের বেলায় মাঝেমধ্যে জলের বোতল বিলি করা হচ্ছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সে সব বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কেন? ইমরান বললেন, ‘‘সাহেবরা (বিএসএফ কর্তারা) আপত্তি করছেন।’’ কিসের আপত্তি? বিএসএফ আধিকারিকদের জিজ্ঞাসা করলে বলছেন, ‘‘আমরা তো ওঁদের জন্য ক্যাম্পে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি। ওখানে যাঁদের পাঠানো হচ্ছে, তাঁদের জন্য তিনবেলা খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।’’ কিন্তু ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে রাস্তাতেই তো তিন-চারদিন করে বসে থাকতে হচ্ছে। তখন ওঁরা খাবেন কী? বিএসএফের আধিকারিক বলছেন, ‘‘চেকপোস্টের বাইরে লাইন তো ক্রমশ বাড়ছে। এখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত যদি লোক বসে থাকতে শুরু করে, সকলের দায়িত্ব কি আমরা নিতে পারব?’’ দায়িত্ব না নিতে পারলে স্থানীয়দের ব্যবস্থাপনায় বাধা দেওয়া কেন? চেকপোস্ট ঘিরে থাকা এক ঝাঁক সিসি ক্যামেরা দেখিয়ে জবাব এল, ‘‘চেকপোস্টের বাইরে যাঁরা, তাঁদের দায়িত্ব আমাদের নয় ঠিকই। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে কোনও অঘটন ঘটে যাবে, সেটা এখানে রেকর্ড হয়ে থাকবে। ঠিক হবে কি? কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কী বিলি করে যাচ্ছে, বুঝব কী ভাবে? তার চেয়ে ওঁরা নিজের দায়িত্বে খাবার কিনে খান।’’ অর্থাৎ, অনুপ্রবেশকারীদের দায়িত্ব বিএসএফের বদলে অন্য কেউ নিচ্ছেন, এই দৃশ্য সিসি ক্যামেরার সামনে তৈরি হতে দিতে চান না বিএসএফ কর্তারা।

অতএব হাকিমপুর বাজারে কামরুল গাজির হোটেলে বিক্রিবাটা বেড়েছে। বেলা সাড়ে ১২টা বাজলেই তিনি সাইকেলের হাতলে বড় বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে বিএসএফের গেট পেরিয়ে চলে আসছেন বাংলাদেশিদের অস্থায়ী শিবিরগুলির সামনে। ডিমভাত ৪০টাকা, মাছভাত ৫০ টাকা, মাংসভাত (মুরগি) ৬০ টাকা। ছোট ছোট পলিথিনের প্যাকেটে একসঙ্গে ভাত-তরকারি ভরে দেওয়া। ডিম, মাছ বা মাংস আলাদা প্যাকেটে। কামরুল সাইকেলে আধবসা অবস্থাতেই বেচাকেনা চালাচ্ছেন। কাগজের থালা পেতে গোল হয়ে খেতে বসে যাচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের এক একটি করে পরিবার। সাংবাদিক দেখে বললেন, ‘‘আমার হোটেলের খুব নাম। একবার খেয়ে যান। বুঝতে পারবেন।’’ কী নাম হোটেলের? কামরুল বললেন, ‘‘নাম নেই। বাজারে গিয়ে কামরুলের হোটেল বলবেন। যে কেউ দেখিয়ে দেবে। এত সস্তায় কেউ মাংসভাত খাওয়াতে পারবে না।’’

কামরুলের হোটেলের মতোই এখন বাংলাদেশিদের অপেক্ষমান শিবিরগুলোও নামহীন। তাঁরা কি অনুপ্রবেশকারী? অবৈধ ভাবে ভারতে অবস্থান করছেন? চেকপোস্টের ভিতরে ডেকে নেওয়ার আগে সে কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার করতে পারবে না বিএসএফ। তাকাবে না পুলিশও। ‘ভারতীয়’ যে তাঁরা নন, সে কথা তাঁরা নিজেরাই মেনে নিচ্ছেন। অদ্ভুত এক রাষ্ট্রহীন দশায় তিনদিন-চারদিন করে খোলা আকাশের নীচে কাটাচ্ছে নামহীন, রাষ্ট্রহীন মানবস্রোত। সে স্রোতকে সীমান্তের ও পারে পাঠানো হচ্ছে দু’তিনটি এলাকায় সীমান্ত খুলে দিয়ে। সেখানেই ‘হস্তান্তর’ হচ্ছে অবৈধবাসীদের। আরশিকারি, পদ্মবিলা, দহরকান্দা, হাকিমপুর, তারালি, আমুদিয়া— এই ছ’টি গ্রামের মাঝে বিভিন্ন অংশ দিয়ে রোজ রাতে পারাপার চলছে। একাধিক ‘ঘাট’ খুলে দিলে সময় কম লাগছে। পারাপারের সংখ্যাও বাংলাদেশের বাহিনীর সিসি ক্যামেরায় বিরাট হয়ে ধরা দিচ্ছে না। কিছুটা ‘ভদ্রস্থ’ দেখাচ্ছে। (চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement