কলকাতা নাম মুছলেও কামারহাটি মদনেরই

মুখ্যমন্ত্রী আশীর্বাদের হাত বুঝি মাথা থেকে সরেছে। তাই খাস কলকাতায়‌ মদন মিত্রের নামে যত হোডিং-ব্যানার শোভা পাচ্ছিল, তড়িঘড়ি সব সরিয়ে ফেলেছে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু পরিবহণমন্ত্রীর খাসতালুক কামারহাটিতে অন্য ছবি। সেখানে রাজপথ থেকে পাড়ার গলি— সর্বত্র ব্যানার-হোর্ডিংয়ে এখনও মদন মিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি!

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

মদন মিত্রের গ্রেফতারির প্রতিবাদে ব্যানার কামারহাটিতে। একই ব্যানার চোখে পড়ছে বেলঘরিয়া, আড়িয়াদহেও। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী আশীর্বাদের হাত বুঝি মাথা থেকে সরেছে। তাই খাস কলকাতায়‌ মদন মিত্রের নামে যত হোডিং-ব্যানার শোভা পাচ্ছিল, তড়িঘড়ি সব সরিয়ে ফেলেছে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু পরিবহণমন্ত্রীর খাসতালুক কামারহাটিতে অন্য ছবি। সেখানে রাজপথ থেকে পাড়ার গলি— সর্বত্র ব্যানার-হোর্ডিংয়ে এখনও মদন মিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি!

Advertisement

কেন কলকাতার বুক থেকে মদনের নাম-ছবি সরানো হল?

তৃণমূলের মহাসচিব তথা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, দলের ‘মুখ’ হলেন একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য কেউ নন। ‘‘দলের ঘোষিত নির্দেশ, মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া কারও ছবি ব্যানারে থাকবে না। শুধু ভোটের সময় হোর্ডিং-ব্যানারে মুখ্যমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ছবি থাকতে পারে।’’— বলছেন পার্থবাবু। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘হোর্ডিংয়ে ছবি থাকায় মদন মিত্র যেমন দোষী, তেমন অন্য কারও ছবি থাকলে তিনিও সমান দোষী।’’

Advertisement

কিন্তু বাস্তব বলছে, মদনবাবুর নির্বাচনী কেন্দ্র কামারহাটি এ নিয়মের ব্যতিক্রম। কী রকম?

বৃহস্পতিবার কামারহাটি চক্কর মেরে দেখা গেল, বড় রাস্তা থেকে অলিগলি— বহু জায়গায় মদন মিত্রের নামাঙ্কিত বিবিধ ব্যানার-হোর্ডিং জ্বলজ্বল করছে। বিটি রোড, নীলগঞ্জ রোড, ফিডার রোড, বেলঘরিয়া, দক্ষিণেশ্বর— সর্বত্র। কোথাও ‘এলাকার মানুষ’ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তাঁদের ‘প্রিয় বিধায়ক’কে বিনা অপরাধে বন্দি করে রাখা হয়েছে? কোথাও অভিযোগ: এলাকাবাসী ২২০ দিন ধরে বিধায়কের উন্নয়নযজ্ঞ থেকে বঞ্চিত। ‘এর বিচার কে করবে?’ আগামী ২১ জুলাই তৃণমূলের ‘শহিদ দিবস’ উপলক্ষে টাঙানো কিছু ব্যানারে মমতা-মদনের ছবি পাশাপাশি!

কামারহাটি কী ভাবে ‘মদন হটাও অভিযানের’ বাইরে রয়ে গেল?

স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে জেলাস্তরের নেতারাও এ প্রসঙ্গে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে বসেছেন। কেউ নিতান্ত দায়সারা গোছের উত্তর দিয়েছেন। যেমন তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, ‘‘দলের কাছে জানতে হবে, মদনের ছবি দেওয়া ব্যানার সরানোর নির্দেশ আছে কি না।’ বিষয়টি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। আবার তৃণমূলশাসিত কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহার মন্তব্য, ‘‘এই ব্যানার দলের কেউ লাগায়নি। অনুগামীরা কে কোথায় কী করছেন, বলা সম্ভব নয়।’’ সুতরাং এ ক্ষেত্রে পুরসভার তরফে তাঁদের কিছু করার নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন চেয়ারম্যান।

এ ভাবে অধিকাংশ স্থানীয় বা জেলা নেতা বিষয়টি থেকে হাত তুলে নিচ্ছেন। কেউ কেউ একান্তে একে ‘উৎসাহী অনুগামীদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে অভিহিত করে তাতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। ঘটনা হল, কলকাতা জু়ড়ে নিজের নামাঙ্কিত ব্যানার-হোর্ডিং প্রসঙ্গে স্বয়ং মদনবাবু ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছিলেন, অতি উৎসাহী কিছু অনুগামী ২১ জুলাইয়ের সভার ব্যানারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি লাগিয়েছিল। জানতে পেরে তিনি নিজেই সে সব খুলিয়ে দিয়েছেন। তা হলে কামারহাটিতে খোলা হল না কেন? ঘনিষ্ঠ মহলে মদনবাবুর ব্যাখ্যা: কামারহাটির মানুষের কাছে তিনি তো শুধু বিধায়ক বা মন্ত্রী নন! তিনি ওঁদের একেবারে কাছের মানুষ, বলতে গেলে নিজের লোক। ওই সব ব্যানার-হোর্ডিংয়ে এলাকাবাসীর সেই ভালবাসারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মদনবাবু মনে করছেন। যে ভাবাবেগে আঘাত করতে তাঁর হাত সরছে না!

স্থানীয় সূত্রে মদনবাবুর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। বস্তুত সিপিএমের দীর্ঘ দিনের ‘দুর্গ’ কামারহাটি তৃণমূলের দখলে আসা ইস্তক সেখানে ‘মদন হাওয়া’র রমরমা। সাত মাস আগে সারদা-মামলায় মদনবাবু গ্রেফতার হওয়ার পরেও যাতে ভাঁটা পড়েনি। কামারহাটি পুরভোটের প্রার্থী-তালিকা তৈরি হোক কিংবা পুরবোর্ড গঠন— সবেতেই জেলবন্দি মদনের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সায় দিয়ে চলেছেন ওখানকার নেতারা। কামারহাটি দখলের পরে মদনের ছবি ছাপানো টি-শার্ট পরে সমর্থকেরা উল্লাসে মেতেছিলেন। সেই ছবিতেই মাখানো হয়েছিল সবুজ আবির।

এমতাবস্থায় কামারহাটি মদনের নাম-ছবি সংবলিত হোর্ডিং-ব্যানারে ছয়লাপ হলে আশ্চর্যের কিছু দেখছে না তৃণমূলের একাংশ। এই মহলের অভিমত, কামারহাটিতে দাঁড়িয়ে মদন মিত্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো বুকের পাটা এখনও কারও নেই। ‘‘কলকাতায় যে কাজ সহজে করা গিয়েছে, সেটা এখানে করা যথেষ্ট কঠিন।’’— পরিষ্কার বলছেন এক স্থানীয় নেতা। আর কোনও

রাখঢাক না-করে তৃণমূলের এক জেলা নেতা জানাচ্ছেন, কামারহাটিতে মদনের নাম মুছতে গেলে ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়ার সমূহ আশঙ্কা। তাই দলের নিয়ম এখানে তাঁরা শিকেয় তুলে রেখেছেন। এবং এ প্রসঙ্গে রামায়ণ-কথাও শোনা গিয়েছে মদন অনুগামীদের মুখে। বেলঘরিয়ার এক নেতা বলেন, ‘‘রামচন্দ্র না-থাকলেও তাঁর পাদুকা সিংহাসনে রেখে ভরত রাজ্যপাট চালিয়েছিলেন। আমরাও তাই করছি। ওঁর হাত ধরে তৈরি হওয়া নেতারাই এখন কামারহাটি চালাচ্ছেন।’’ কাজেই কামারহাটিতে অন্তত ‘দাদা’র ছবি খোলা সহজ হবে না বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন ‘ভাই’রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন