প্রতিবেশী বাংলাদেশ পারে। সেই পথ অনুসরণ করে ভারতীয় রেলও কেন নিজেদের ঠনঠনে ভাঁড়ার ভরার চেষ্টা করছে না, উঠছে প্রশ্ন। এবং সেই প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন এক শ্রেণির রেলকর্তাও।
পথটা কী?
রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, এ দেশের রেলের মতো বাংলাদেশও তাদের রেলে নিজস্ব যোগাযোগের জন্য লাইনের পাশ দিয়ে দেশ জুড়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল পেতেছে। সেই কেব্লের দু’টি লাইন তারা লিজ দিয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থাকে। ওই সংস্থা রেলের সেই কেব্লের উপরে নির্ভর করে গোটা দেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালায়। বিনিময়ে ওই সংস্থা নেটওয়ার্ক ভাড়া বাবদ বিরাট অঙ্কের অর্থ দেয় রেলকে। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে মোবাইল সার্ভিস দেয় রেলের কর্মী-অফিসারদের।
আয় বাড়াতে বাংলাদেশের দেখানো এই রাস্তা ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক রেলকর্তা। তাঁদের বক্তব্য, এ দেশে রেলের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রথম থেকেই অনেক উন্নত। রেল কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশ জুড়ে উন্নত অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল পেতে রেখেছে। সেখান থেকে তারা অনায়াসেই একটি বা দু’টি লাইন ভাড়া দিতে পারে। তা থেকে রেলের ভাঁড়ারে আসতে পারে প্রচুর অর্থ। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে অসুবিধে থাকলে লিজ দেওয়া যায় সরকারি সংস্থাকেও।
রেলের অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকারি টেলিকম সংস্থার এক শ্রেণির কর্তা জানাচ্ছেন, রেল কী করবে, সেটা তাদের বিষয়। তবে কার্যক্ষেত্রে রেলের কেব্ল অন্যান্য সংস্থার কেব্লের থেকে অনেক বেশি উপযোগী। ওই টেলিকম-কর্তাদের বক্তব্য, দেশে দু’-একটি বেসরকারি সংস্থারও কেব্ল লাইন আছে। কিন্তু তাদের কেব্ল লাইন গিয়েছে সড়কের আশপাশ দিয়ে। ফলে রাস্তা মেরামত, বা খোঁড়াখুঁড়ি হলেই কেব্ল কেটে যায়। তার উপরে চোরের উপদ্রব তো আছেই। সেই তুলনায় রেলের কেব্ল তাদের ট্রেন চলাচলের লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়ায় অনেক বেশি নিরাপদ ও বিশ্বস্ত। এতে লাইন বসে যাওয়ার সমস্যা নেই। তাই ওই লাইন দিয়ে ‘ডে়টা ও ভয়েস’ পাঠানো হলে তা হবে অনেক পরিষ্কার ও নিরবচ্ছিন্ন।
ভাঁড়ে মা ভবানী দশা কাটাতে রেল তাই বাংলাদেশের ওই রাস্তা ধরতেই পারে বলে মনে করেন রেলকর্তাদের একাংশ। রাজনীতির অঙ্ক জড়িয়ে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনভাড়া বাড়ানোর ঝুঁকি নেয়নি বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন শিবির। তাই আয় বাড়ানোর বিকল্প পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রেল। বিগত আর্থিক বছরের শুরুতে ঢাক বাজিয়ে আয় বাড়ানোর কথা জানিয়েছিলেন বোর্ডকর্তারা। কিন্তু নতুন অর্থবর্ষের শুরুতে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তারা পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই।
রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, গত কয়েক বছরের মতো এ বারেও রেলের আর্থিক অবস্থা যে খুব ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, পরিসংখ্যানেই সেটা পরিষ্কার। সেই জন্যই রেল বোর্ড তড়িঘড়ি সব জোনকে আয়ের বিকল্প রাস্তা খোঁজার নির্দেশ দিয়েছে।
কী বলছে পরিসংখ্যান?
রেল বোর্ড সূত্রের খবর, ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরের শেষ মাসে অর্থাৎ মার্চে রেলের আয় কমেছে ৭৯৮ কোটি টাকা। আর প্রায় ১৩৭৪ কোটি টাকা আয় কমেছে নতুন অর্থবর্ষের (২০১৬-’১৭) প্রথম মাসে। নতুন বছরের প্রথম মাসে রেলের আশা ছিল, যাত্রী হবে ৬৭ কোটি ৬৩ লক্ষ। কিন্তু হয়েছে ৬৫ কোটি ৬৩ লক্ষ। অর্থাৎ প্রায় দু’কোটি কম। ভাড়া বাবদ আয়ও কমেছে সেই অনুপাতে। রেল বিলক্ষণ জানে, বিপুল সংখ্যক যাত্রী রোজই বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়েন এবং তাঁদের জরিমানা করলে আয় বাড়বেই। কিন্তু নিয়মিত ধরপাকড় অভিযান চালানোর কার্যকর বন্দোবস্ত হচ্ছে না।
রেলের মূল আয় হয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ থেকে। গত কয়েক বছরে দু’টোই ক্রমশ কমছে। তার জেরে রেলের নতুন প্রকল্প থেকে শুরু করে পরিকাঠামো নির্মাণ পর্যন্ত সব কাজই চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। প্রাক্তন রেলকর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের কথায়, ‘‘যাত্রী কেন কমছে, রেলকে সেটা খুঁজে বার করতেই হবে। নইলে আয় বাড়ানো মুশকিল।’’ বেশির ভাগ জরুরি প্রকল্পই এখন রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে রূপায়ণের পরিকল্পনা নিচ্ছে রেল মন্ত্রক। রেলকর্তাদের বক্তব্য, আর্থিক দুর্দশা না-কাটলে পরিষেবার উপরে প্রভাব পড়তে বাধ্য। রেল বোর্ডের কোনও কোনও কর্তা বলছেন, নতুন আর্থিক বছরের সবে তো এক মাস হল। হাতে আরও ১১ মাস রয়েছে। যে-ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে আয় বাড়বেই। পণ্য পরিবহণ বাড়াতে লৌহ আকরিক রফতানির মাসুলে কিছু ছাড়ের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু এ-পর্যন্ত বিকল্প আয়ের যে-সব প্রস্তাব রেলের বিভিন্ন জোনে পাঠানো হয়েছে, তা থেকে রাতারাতি বিপুল আয় হবে বলে মনে করেন না অনেক রেলকর্তা। তাঁদের কথায়, রেলের কর্মী-অফিসারদের পোশাকে বিজ্ঞাপন, স্টেশনে বিজ্ঞাপনের জায়গা ভাড়া দেওয়ার মতো কিছু প্রস্তাব এসেছে। তবে সেগুলো তেমন সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই ভাঁড়ার চাঙ্গা করার জন্য নতুন কিছু ভাবতে হবে। সঙ্কট কাটাতে রেলকর্তারা এখন আয়ের বিকল্প পথ সন্ধানে নেমেছেন।
সে-ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলের কেব্ল-পরিকল্পনা পথ দেখাতে পারে বলে রেলকর্তাদের একাংশের ধারণা।