নোট-বাতিলের ধাক্কায় মজুর লাগানোর ক্ষমতা নেই

ধান কাটতে ডাক পড়ছে মেয়ে-জামাইয়ের

মাঠ ভরা পাকা ধান ভারে নুইয়ে আসছে মাটির দিকে। হেমন্তের এই সময়টায় দম ফেলার জো থাকে না খেতমজুরদের। কিন্তু এ বারে সমস্তটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। হুড়া চাকলতা গ্রামের বাসিন্দা পাণ্ডব বাউরি দিনমজুরি করে সংসার চালান।

Advertisement

প্রশান্ত পাল ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৫
Share:

সবুর নয়। নিজের জমিতে একাই ধান কাটতে নেমেছেন আইলঠ্যা গ্রামের বৃদ্ধ চাষি। ছবি: সুজিত মাহাতো।

মাঠ ভরা পাকা ধান ভারে নুইয়ে আসছে মাটির দিকে। হেমন্তের এই সময়টায় দম ফেলার জো থাকে না খেতমজুরদের। কিন্তু এ বারে সমস্তটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। হুড়া চাকলতা গ্রামের বাসিন্দা পাণ্ডব বাউরি দিনমজুরি করে সংসার চালান। তিনি বলেন, ‘‘আগে কেউ যদি বলত দিন পিছু একশো চল্লিশ টাকা দেবে, তাহলে কিছুক্ষণ পরে অন্য কেউ একশো, দেড়শো দিতে চাইতো। এখন তো কেউ বলছে পাঁচশোর নোট দেব, কেউ বলছে হাজারের নোট। দিন আনি দিন খাই। অচল বড় নোট থাকাও যা, না থাকাও তা।’’

Advertisement

খেত মজুরেরা কাজ না পেয়ে বাড়িতে বসে থাকছেন। এ দিকে পাকা ধান একটু একটু করে ঝরে যাচ্ছে। অগত্যা কোমর বাঁধছেন অনেক চাষি। কাস্তে হাতে নিজেরাই নেমে পড়ছেন মাঠে। শুক্রবার দুপুরে স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে নিজেদের খেতে ধান কাটছিলেন হুড়া ব্লকের জবড়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান, নডিহা গ্রামের বাসিন্দা বঙ্কবিহারীবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সরকার রাতারাতি টাকা বাতিল করে আমাদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। এই বয়সে আর শরীর চলে না। কিন্তু উপায় কী!’’

পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিলে ধাক্কা খেয়েছে জেলার চাষ। একই সঙ্গে বিপাকে পড়েছেন চাষি এবং খেতমজুরেরা। টাকা তোলার নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়ায় মজুরি দেওয়ার মতো অর্থ জোগাড় করতে পারছেন না অনেক চাষি। কেউ কেউ বসে রয়েছেন হাতে বেশ কিছু দু’হাজার টাকার নোট নিয়ে। বঙ্কবাবুর স্ত্রী সত্যবতীদেবী জানান, ভাঙানি পাওয়ার অসুবিধার কথা বলে শ্রমিকেরা দু’হাজারের নোট নিতে চাইছেন না। তাই তাঁদের পরিবারের সবাইকে নামতে হয়েছে মাঠে।

Advertisement

জেলার জঙ্গলমহল ব্লক সারেঙ্গার বীরভানপুরের বাসিন্দা মধুসূদন ধর চাষ করেছেন চার একর জমিতে। তাঁর আক্ষেপ, “প্রতিদিন তীর্থের কাকের মত ব্যাঙ্কে হত্যে দিয়ে হাতে গোনা ক’টা টাকা পাচ্ছি। তা দিয়ে সংসার চলে, খেতমজুর লাগানো যায় না। নিজেদেরই এ বারে মাঠে নামতে হবে। কিন্তু পরবারের সবাই মিলেও যদি কাজ করি, চার একর জমির কাছে সেটা নস্যি!’’

যাঁদের জমি কিছুটা কম, তাঁদের লোকসানের দুশ্চিন্তা কিছুটা কম। যেমন বাঁকুড়ার আইলঠ্যা গ্রামের চাষি রবি কারক। চাষ করেছিলেন বিঘা পাঁচেক জমিতে। রবিবাবু বলেন, ‘‘ধান মাঠ থেকে তুলে আলু লাগাতাম। কিন্তু যা টাকা তুলেছি সমস্তটাই সংসার খরচে চলে গিয়েছে। টাকার অভাবে ধান তুলতে পারছি না।’’ চট করে যে বেশি টাকা হাতে আসবে না তা বিলক্ষণ টের পেয়েছেন রবিবাবু। অপেক্ষা করলে অনেক ফলস নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে অল্প অল্প করে নিজেরাই ধান কাটা শুরু করেছেন। একই পথে হেঁটেছেন বাঁকি গ্রামের চাষি ভোলানাথ মাঝি, রঞ্জন মাঝিরা। ভোলানাথবাবু বলেন, “নিজের টাকা নিজেই তুলতে পারছি না। এমন বিপত্তিতে কখনও পড়িনি। মজুরেরা তো আর ধারে কাজ করবেন না। নিজেরাই চেষ্টা করছি, যতটুকু পারি।’’

বিপত্তি আরও অনেক রকমের। কারও ভাঙতে হয়েছে সামান্য সম্বল। যেমন মানবাজার থানার চিন্তামণি কর্মকার। একশো টাকার নোটে কিছু সঞ্চয় ছিল ঘরে। অসুস্থ ছেলের চিকিৎসা মুলতুবি রেখে সেই টাকায় খেতমজুরদের মাঠে কাজে লাগিয়েছেন। চিন্তামণিদেবী বলেন, ‘‘ধান না উঠলে আরও মুশকিলে পড়ব। চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই তখন অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।’’ অন্য দিকে সচল টাকা হাতে নিয়েও সমস্যার সুরাহা করতে পারছেন না কেউ কেউ। কারণ, সেই টাকা দু’ হাজারের নোটে। সামনেই বার্ষিক পরীক্ষা। তবু নবম শ্রেণির পড়ুয়া মেয়েকে মাঠের কাজে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন নড়রা গ্রামের বাসিন্দা ভূদেব মাহাতো। ফুফুন্দি গ্রামের প্রভাস এবং উর্মিলা মাহাতোর সঙ্গে পড়া ফেলে মাঠে নেমেছেন তাঁদের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মনোজ।

এই পরিস্থিতিতে অনেকে সাহায্য চেয়ে পাঠাচ্ছেন আত্মীয়দের কাছে। পুরুলিয়ার হুড়ার ফুফুন্দি গ্রামের প্রৌঢ়া তুলসী কিস্কু কাশীপুরের মাজুরা গ্রাম থেকে ডেকে এনেছেন মেয়ে জামাইকে। তিনি বলেন, ‘‘ধান তো ঘরে তুলতেই হবে। ওদের কাটা হয়ে গিয়েছে, তাই আমাকে সাহায্য করতে এসেছে। আমিও পরে ওদের সাহায্য করতে যাব।’’

চাষিরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার এক প্রকার চেষ্টা করলেও দুর্দশা কাটছে না খেতমজুরদের। ভরা মরসুমেও কাজ না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন ওন্দার জনমজুর নির্মল পাইন, সুশীল মহন্তরা। তাঁরা বলেন, “আমাদের হাতে কাজই নেই। চাষিরা নিজেরাই মাঠে ধান কাটছেন। যেটুকু কাজ পেয়েছি তার বেশিরভাগটাই ধারে পড়ে রয়েছে এখনও।”

সহ প্রতিবেদন: সমীর দত্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন