ফসল: মাঠ থেকে ঘরে উঠেছে ধান। ঝেড়ে নিচ্ছেন এক আদিবাসী বধূ। বাঁকুড়ার সিমলাপালের বীরসিংহপুর গ্রামে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
দাম আরও বাড়িয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই নেপোতেই মেরে গেল দই। সহায়ক মূল্যে ধান কেনা যত দিনে শুরু হয়েছে বাঁকুড়ার বিভিন্ন জায়গায়, অনেক প্রান্তিক চাষিই তত দিনে দেনা শুধতে ফ়ড়েদের কাছে বেচে দিয়েছেন ধান। পরিস্থিতি কেমন, সেটা দেখতেই সোমবার যাওয়া হয়েছিল বিষ্ণুপুর মহকুমার দু’টি জায়গায়। উলিয়াড়া পঞ্চায়েতের প্রকাশ সমবায় সমিতি। আর দ্বারিকা-গোঁসাইপুর পঞ্চায়েতের সুভাষপল্লি।
সম্পন্ন চাষিদেরই লাভ সোমবারই উলিয়াড়ার প্রকাশ সমবায় সমিতি জানিয়েছে, মঙ্গলবার থেকে সেখানে সরকারি দামে ধান কেনা হবে। ঝুলেছে নোটিস। টাঙানো হয়েছে প্ল্যাকার্ড। মাইক নিয়ে এলাকায় ঘুরে ঘুরে বলেও বেড়ানো হচ্ছে খবরটা। ম্যানেজার তপন গঙ্গোপাধ্যায় জানান, সমিতিতে ২৯টি গ্রামের কৃষকেরা রয়েছেন। এক কুইন্টাল চালের দাম মিলবে ১৭৫০ টাকা। গত বারের তুলনায় কড়কড়ে দু’শো টাকা বেশি।
‘‘বেল পাকলে কাকের কী?’’, বলছিলেন জিতেন লোহার আর শিবু লোহার। উলিয়াড়ারই নতুনগ্রামের প্রান্তিক চাষি তাঁরা। প্রকাশ সমবায় সমিতির সদস্যও। দু’জনেই অন্যের জমি চুক্তিতে নিয়ে চাষ করেছিলেন এই বছর। দারকেশ্বরের তীরের উর্বর মাটিতে স্বর্ণ ধানের ফলন হয়েছে ভালই। কিন্তু বীজ, সার, কীটনাশক— সবই কিনেছেন ধারে। ফসল উঠলেই সেই দেনা চোকাতে হয়। দাম কবে উঠবে, সেই অপেক্ষায় থাকার জো নেই। জিতেন বলেন, ‘‘এক মাস আগেই ধান বেচে দিয়েছি। মাঠ থেকে নিয়ে গিয়েছে।’’
জমি ছাড়াও ক্রেডিট কার্ড
• একই মৌজার ৪ থেকে ১৪ জন মিলে একটি দল তৈরি করতে হবে। এই দলগুলিকে বলে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’।
• সমবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তার পরে যেতে হবে ব্যাঙ্কে।
• দলের প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। সুদ বছরে শতকরা ৭ টাকা।
• সময় মতো ঋণ শোধ করে দিলে সুদে মিলবে ছাড়।
জিতেন এবং শিবু প্রতি কুইন্টাল ধানের দর পেয়েছেন ১১০০ টাকা। তবে নগদে দাম মিটিয়ে দিয়েছে ফড়েরা। যা লাভ হয়েছে, তাতে পাওনাদারের টাকা শোধ করে আবার আলু বুনেছেন। শিবু বলেন, ‘‘আফশোস করা ছাড়া আমাদের কী বা করার আছে? একে তো এত দিন পরে ধান কেনা শুরু হল। তার উপরে টাকা আসবে অ্যাকাউন্টে, দিন কতক পরে। তত দিনে সুদে-আসলে যা দেনা আরও বেড়ে যাবে। আলু লাগানোর সময়টাও কাবার হতে বসবে।’’
প্রকাশ সমবায় সমিতির তপনবাবু অবশ্য দাবি করছেন, ফড়েরা মেরেকেটে তিরিশ শতাংশ ধান কিনেছে। গ্রামগুলিতে এখনও সত্তর শতাংশ ধান রয়েছে। জিতেনদের বক্তব্য, ওই তিরশ শতাংশেই পড়ে যাচ্ছেন তাঁদের মতো ভূমিহীন প্রান্তিক চাষিরা। তাঁরা বলেন, ‘‘সরকারি দামের লাভটা তো তাহলে বড়লোক চাষিরাই পাচ্ছেন।’’
প্রান্তিক চাষিদের পথ জমিও যাঁর নেই, পুঁজিও নেই— কী করছেন সেই প্রান্তিক চাষিরা?
দ্বারিকা-গোঁসাইপুর পঞ্চায়েতের সুভাষপল্লির স্বপন ভদ্র, বিমল বিশ্বাসেরাও এ বার ধান বেচেছেন ফড়ের কাছে। তাঁরা আবার রানিখামার সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির সদস্য। সমিতির সম্পাদক অজয় রায় বলেন, ‘‘প্রান্তিক চাষিরা যদি সবাই মিলে ধান জড়ো করে আমাদের ফোনেও বলে দেন, তাহলে গাড়ি পাঠাতে পারি।’’
তা হলে? খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, অনেক ক্ষেত্রেই মরসুমের গোড়ায় মহাজন হয়ে যে লোকটি চাষিকে ধার দেয় ফসল উঠলে সেই আসে ফড়ে হয়ে ধান কিনে নিতে। মাঝের সময়টায় তিল তিল করে বড় হয় ফসল আর সুদ।
আইচবাড়ির তিলক ধক, কানাই মাঝিরা বলেন, ‘‘বিপদের সময়ে ভরসা করে ওঁরা টাকাটা দেন। ধান উঠলে তাই আমাদেরও মনে হয় একটা দায় রয়েছে।’’
ভরসা করে সরকারও তাঁদের পুঁজির টাকা দিতে তৈরি আছে বলে জানাচ্ছেন মহকুমা কৃষি আধিকারিক (বিষ্ণুপুর) হেমন্তকুমার নায়েক। তিনি জানান, কিসান ক্রেডিট কার্ড ভূমিহীন প্রান্তিক চাষিদেরও অধিকার। তার জন্য একই মৌজার কয়েক জন মিলে ছোট-বড় দল বেঁধে নিতে হবে শুধু। চাষিদের মধ্যে এই ব্যাপারটা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন হেমন্তবাবু।
তবে চেষ্টার কী ফল ফলেছে, মরসুম ফুরনোর সময়ে বাতাসে ভাসছে সেই প্রশ্নটাই।