হারানো মেয়েকে পেয়েও অসহায় মা

মেয়ে বাড়ি ফিরলেও শয্যাশায়ী ছেলে এবং পরিবারের অর্থকষ্টের কথা ভেবেই চোখে জল বেলানুরের। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটা বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু আনন্দ করতে পারছি না। ছেলে চিকিৎসায় সব টাকা শেয। ফের অস্ত্রোপ্রচারের জন্য যে টাকা লাগবে তা-ও নেই। বন্ধ ছেলের রোজগারও।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৮ ০১:০৮
Share:

শূন্যতা: দাদা নীলু খানের সঙ্গে টগরী। লোহাবাজারের বাড়িতে। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

বাইশ বছর পর বাড়ি ফিরেছে হারানো মেয়ে। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ভাসবে পরিবার, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চিন্তার ভাঁজ পড়েছে মহম্মদবাজার ব্লকের লোহাবাজার খান পরিবারে।

Advertisement

পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাড়ির একমাত্র রোজগেরে শয্যাশায়ী দীর্ঘ দিন। চিকিৎসা করানোর পয়সা নেই। দু’বেলা দু’মুঠো জোগাড় করাই কঠিন হতদরিদ্র সেই পরিবারের পক্ষে। তার মধ্যে আচমকা সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়াটাই চিন্তার কারণ!

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল মহম্মদবাজারের লোহাবাজারের বাসিন্দা বেলানুর বিবির। ২৬ বছর আগে বড় মেয়ে টগরীর বিয়ে দিয়েছিলেন বেলানুর। নিম্নবিত্ত পরিবারে যে ভাবে সম্ভব, ঠিক সে ভাবেই। জামাই শাহবু শেখ রানিগঞ্জের বাসিন্দা। মণ্ডপ ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। বছর তিন-চারেক সব ঠিক ছিল। টগরীর একটি কন্যাসন্তান হয়। দু’বছর আগে হঠাৎই ছবিটা বদলে যায়। বেলানুর জানতে পরেন, তাঁর মেয়ে টগরী ও নাতনিকে বিহারের কোথাও ছেড়ে এসে অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে শাহবু। তাঁদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি জামাই।

Advertisement

ট্রেনে ট্রেনে বা বিভিন্ন এলাকায় ম্যাজিক দেখানোই পেশা ছিল টগরীর দাদা নীলু খানের। যেটুকু সঞ্চয় ছিল বোনের খোঁজ করতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায়। গত কাল সকালে সেই বোন নিজেই ফেরেন বাড়িতে। সব কিছু খুইয়ে। বাংলা কথাও।

পরিবার জেনেছে, স্বামী ভিনরাজ্যে ছেড়ে আসার পর বাপের বাড়িতে ফেরার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কোনও ভাবে সেই সুযোগ পাননি। ১৯৯৯ সালে এক দুর্ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও স্মৃতি হারিয়েছিল টগরীর। দুর্ঘটনায় সন্তানকেও হারান তিনি।

কয়েক দিন আগে কিছুটা ফেরে স্মৃতি। মহম্মদবাজারে এক পিসতুতো ভাইয়ের নাম-ঠিকানা বলতে পারেন। সেই সূত্রে ফেরেন বাড়িতে। কিন্তু কোথায়, কবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা মনে করতে পারেননি। তার পর কোথায় ছিলেন, সে কথাও তার মনে নেই। পায়ের গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে শুধু বলেছেন, ‘‘ও সব মনে নেই, বেশি ভাবলে মাথায় যন্ত্রণা করে।’’

বোনকে ফিরে পেয়ে খুশি দাদা। খুশি বেলানুর বিবিও। কিন্তু তার মধ্যেই রয়েছে দেখা দিয়েছে চিন্তা।

ছ’মাস আগে নীলুর পায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি মোটরবাইক। সিউড়ি সদর হাসপাতাল, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসার পরও পা ভাল হয়নি। বরং পচন ধরেছে তাতে।

মেয়ে বাড়ি ফিরলেও শয্যাশায়ী ছেলে এবং পরিবারের অর্থকষ্টের কথা ভেবেই চোখে জল বেলানুরের। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটা বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু আনন্দ করতে পারছি না। ছেলে চিকিৎসায় সব টাকা শেয। ফের অস্ত্রোপ্রচারের জন্য যে টাকা লাগবে তা-ও নেই। বন্ধ ছেলের রোজগারও।’’

নীলুর বাড়িতে সোমবারও ভিড়। কী ভাবে ফিরলেন, কোথায় ছিলেন টগরী— সবাই আসছেন তা জানতে। নীলু বলেন, ‘‘ম্যাজিক দেখিয়ে ভালই রোজগার হত। কিন্তু এখন চার সন্তান, স্ত্রী, মাকে নিয়ে পেট চালানোই সমস্যার। পঞ্চায়েত, ব্লক, সংখ্যালঘু দফতরে আবেদন করেছিলাম। সাড়া পাইনি।’’ ম্যাজিক দেখানোর পোষা পায়রাগুলির দিকে চেয়ে তাঁর আক্ষেপ— ‘‘ম্যাজিক করে যদি সব কিছু ঠিক করা যেত!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন