একের পর নির্বাচন চলে যাচ্ছে। আর জেলাতে বামপন্থী শক্তি ক্রমশ যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবুও কেউ কেউ থেকে গিয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বর্তমানের শাসকদল তৃণমূল সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও এখনও তাঁদের কাছে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হয়— এমন নজির রয়েছে জেলায়।
এ বারের পুরভোটে জেলাতে কেবলমাত্র রামপুরহাট পুরসভা থেকে বামফ্রন্টের দু’জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রামপুরহাট পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সঞ্জীব মল্লিক আছেন। সঞ্জীব মল্লিকের জয়ের ব্যবধান এ বারও পুরসভার সমস্ত জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে সব থেকে বেশি। একই ওয়ার্ড থেকে পরপর তিন বারের জয়ী কাউন্সিলর সঞ্জীব মল্লিক এ বারে তাঁর নিকটতম প্রার্থী তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১০১৭ ভোটে পরাজিত করেছেন। পুরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে যে দশটি ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী মিনাক্ষী ভকত সব থেকে বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন। মীনাক্ষি ভকত তাঁর নিকটতম প্রার্থী বিজেপি-র ত্রিবেণী মণ্ডলকে ৯৭১ ভোটে পরাজিত করেছেন। তবে বামফ্রন্টের এই দুর্দিনে শিলিগুড়ি জয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সাফল্য যখন আজকে বামনেতৃত্বের কাছে একটা ‘লাইন আপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অশোক ভট্টাচার্যের নীতিতে আগামীদিনে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে বলে অনেক বামফ্রন্ট নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, তখন রামপুরহাটে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সঞ্জীব মল্লিকের পর পর নির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে পারা অবশ্যই জেলা বাম নেতৃত্বের কাছে মৃত সঞ্জীবনী সুধা হিসাবে কাজ করবে বলে অনেকে মনে করছেন। সিপিএমের জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোম মনে করেন, ‘‘সঞ্জীব মল্লিকের সাফল্য অবশ্যই দলের কাছে একটা দৃষ্টান্ত। কোনও লাইন আপ নয়, আজকের পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করাটাই এই সাফল্যের চাবিকাঠি এবং এটাই আমাদের কর্মীদের কাছে নির্দেশ— কী রাজনৈতিক, কী সামাজিক, কী সাংস্কৃতিক সমস্ত দিক থেকে মানুষের পাশে থাকলে মানুষই জয় এনে দেবে।’’
রামপুরহাট পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ড দীর্ঘদিন থেকে বামফ্রন্টের দখলে। সঞ্জীববাবু ২০০৫ সাল থেকে ওই ওয়ার্ডে ২৩৫ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। ২০১০ সালে সঞ্জীববাবু ওই ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিলেন ১২৩৫ ভোটের ব্যাবধানে। ২০১১ সালে যখন রাজ্যে বাম জমানা শেষ হয়ে তৃণমূল রাজ কায়েম হয়েছে তখন রামপুরহাট পুরসভায় একমাত্র ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাম প্রার্থী তৃণমূলের চেয়ে ৫৮৫ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। আবার ২০০৯ সালে জয়ী হওয়ার পর তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় রামপুরহাট মহকুমা এলাকায় সাংসদ এলাকার কাজকর্মের জন্য সাংসদ অফিস রামপুরহাট পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে খুললেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই ওয়ার্ড থেকে তিনি ৮৯১ ভোটে সিপিএম প্রার্থী কামরে ইলাহির কাছ থেকে পরাজিত হয়েছিলেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে সঞ্জীববাবুর সাফল্যকে দলীয় কর্মীরা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে ওয়ার্ড থেকে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা যে ব্যাবধানে জয়ী হন, পুরসভা নির্বাচনে বিগত তিন বছর থেকে সঞ্জীবাবুর ক্ষেত্রে সেই ব্যাবধান বেড়ে গিয়ে ৭৫ শতাংশ হয়।’’
কী বলছে বিরোধীরা? তৃণমূলের জেলা সহসভাপতি অশোক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘১৭ নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের সংগঠন দুর্বল। হারের বিষয় পর্যালোচনা করা হবে।’’ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির মন্তব্য, ‘‘এটা বামেদের নয়, ব্যক্তি সঞ্জীব মল্লিকের জয়।’’
সঞ্জীববাবু অবশ্য বলেন, ‘‘বাবা ছিলেন এই ওয়ার্ডের দলের শাখা কমিটির শাখা সম্পাদক। বামপন্থী ঘরানায় বড় হয়ে ছাত্র রাজনীতি। শ্রমিক সংগঠনও সামলেছি। এই ওয়ার্ডে দলীয় সংগঠনের যে বীজ আমার পূর্বসূরীরা রোপণ করে গিয়েছেন, আমি সেটা যেমন লালন পালন করি তেমনি মানুষের পাশে থেকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে দলমত নির্বিশেষে কাজ করি। আমি মনে করি পুরসভার কাজ যেমন রাস্তা, নর্দমা, পানীয় জল, আলোর সমস্যার সমাধান করা যেমন আছে, তেমনই সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও দিনরাত মানুষের পাশে থেকে কাজ করলেই সাফল্য আসবেই। তা না হলে এ বারের নির্বাচনে শাসকদলের যাবতীয় প্রলোভন, সন্ত্রাস, রামপুরহাট থানার আইসি’র প্রকাশ্যে শাসকদলের হয়ে কাজকর্ম, তৃণমূল না করার জন্য চাপ উপেক্ষা করে ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে সকাল দশটার মধ্যে ৬০ শতাংশ ভোট পড়ত না।’’