ব্যাঙ্কের মেঝেতে খুচরো

জেলার বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তারা জানাচ্ছেন, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচুর খুচরো বাজারে ছেড়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০১:০৬
Share:

কৌটবন্দি: বাঁকুড়া পুর-বাজারের একটি দোকানে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

আগে বাজারে দেখা মিলত কম। ব্যবসায়ীরা ছুটতেন বাট্টা দিয়ে নোট ভাঙাতে। এখন পরিস্থিতি উল্টো। ব্যবসায়ীদের সিন্দুক উপচে পড়েছে কয়েনে। সেই বোঝা নামিয়ে কাঁধ হালকা করতে হত্যে দিয়ে তাঁরা পড়ে থাকছেন ব্যাঙ্কে। কিন্তু ব্যাঙ্কও করছে গড়িমসি। এক কথায়, সব মিলিয়ে কয়েন-গেরোয় জেরবার জেলা।

Advertisement

এমনটা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি হল?

জেলার বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তারা জানাচ্ছেন, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচুর খুচরো বাজারে ছেড়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সাধারণ মানুষ তখন মুখ বুজে ছেঁড়া একশো টাকা, ফাটা কুড়ি টাকা আর রঙ মাখা দশ টাকার নোট দিয়ে লেনদেন সারছেন। ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়ে একগাদা খুচরো নিয়েছেন। ওই পরিস্থিতিতে গোঁ ধরার জো ছিল না। কিন্তু পরে বাজারে এসেছে নতুন পাঁচশো আর আনকোরা দু’হাজার টাকার নোট। আর গোল বেঁধেছে এত দিনের জমা রাশি রাশি কয়েন নিয়ে।

Advertisement

নোট বাতিলের বছর পার করে এখন পরিস্থিতি কেমন?

বিষ্ণুপুরের মোলডাঙা এলাকার মুদি দোকানি সুকুমার দে জানান, তাঁর কাছে তিরিশ হাজার টাকারও বেশি খুচরো কয়েন জমে রয়েছে। ওই এলাকার চা বিক্রেতা সমরেশ রুদ্রর কাছে জমেছে কম করে হাজার চল্লিশ টাকার কয়েন। তাঁদের জিজ্ঞাসা, ‘‘করবটা কী?’’

একই দশা জেলা জুড়ে। বাঁকুড়ার অনেক বড় ব্যবসায়ীই জানাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় কয়েনের পাহাড়ের উপরে বসে আছেন। তাঁদেরই একজন বলছেন, ‘‘সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল না, হাজার হাজার নোট উড়ছে আর উত্তমকুমার তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন! আমারও আজকাল ওই রকমের দুঃস্বপ্ন দেখি। হাজার হাজার কয়েন জমে পাহাড় হয়েছে। তার মধ্যে আটকে আছি। ডিঙোতে পারছি না।’’

ওজর আপত্তি বিস্তর। কয়েন গোনা ঝকমারি। কয়েন বয়ে নিয়ে যাওয়া মুশকিলের। কয়েন ক্রেতা নিতে চান না। কয়েন দোকানদার নিতে চান না। মহাজন নিতে চান না। ব্যাঙ্ক নিতে চায় না। মোদ্দা কথায়, এই ধরণের থাক থাক অজুহাতের মধ্যে প্রায় অচল হয়ে রয়েছে খুচরোর লেনদেন। কেউই নিতে চাইছেন না, আর যুক্তি হিসেবে বলছেন— অন্যরা নিচ্ছে না! এই সমস্ত নিয়ে ঝামেলাও হচ্ছে বিস্তর। চাপের মুখে মুখ হাঁড়ি করে অল্প খুচরো অনেক দোকানদার নিচ্ছেন। তাঁদেরই এক জনের মন্তব্য, ‘‘খুচরো নেওয়ার সময়ে মনে করছি, একটা ট্যাক্স দিচ্ছি। কয়েনগুলো তার রসিদ। ফাইলে গুছিয়ে রেখে দেব।’’

ক্রেতা, বিক্রেতা, মহাজন পেরিয়ে অধিকাংশ দোষ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ছে ব্যাঙ্কের ঘাড়ে। বাঁকুড়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক তথা কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপা বলেন, “গোটা সমস্যার শুরু হচ্ছে ব্যাঙ্কের মানসিকতা থেকেই। ব্যবসায়ীরা কয়েন নিয়ে না পারছেন জিনিস কিনতে, না পারছেন ব্যাঙ্কে জমা করতে।’’

ব্যাঙ্ক কয়েন নিচ্ছে না কেন? কোন যুক্তিতে?

একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের বক্তব্য, “পরিস্থিতিতে বুঝেই গ্রাহকদের কাছ থেকে কয়েন জমা নেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।”

কী এমন পরিস্থিতি?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জেলার একটি চেস্ট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার বলছেন, ‘‘ব্যাঙ্ক কোন ছার! রিজার্ভ ব্যাঙ্কই কয়েন নিচ্ছে না। আমরা বারবার সমস্যার কথা জানিয়েছি। প্রতিবারই বলা হয়েছে, কয়েন গ্রাহকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।’’ তিনি জানাচ্ছেন, তাঁদের শাখায় এখন প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার কয়েন জমে রয়েছে। ভল্টে রাখা যাচ্ছে না, ফেলে রাখা হয়েছে একটি ঘরের মেঝেয়। এমনটা করা যায়? ওই কর্তার মন্তব্য, ‘‘আঁতুরে নিয়ম নাস্তি।’’ বাঁকুড়া জেলায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চেস্ট ব্রাঞ্চ রয়েছে মোট পাঁচটি। সেখানে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে জমা পড়া টাকা গিয়ে পড়ে। সেখান থেকে কিছু দিন পরপর টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। সর্বত্রই এখন ছবিটা কমবেশি এক। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লইজ অ্যাসোসিয়েশনের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক সাগর রায় বলেন, “নিয়ম ভেঙে ভল্টের বাইরে কয়েন রাখতে হচ্ছে। কিছু ঘটে গেলে তার দায় তো ব্যাঙ্কের কর্মীদের উপরে চাপবে। গ্রাহকেরা কয়েন জমা করতে না পেরে ব্যাঙ্কের কর্মীদের সঙ্গেই ঝামেলা করছেন।’’

অতঃকিম?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের টনক যাতে নড়ে, সে জন্য এ বারে বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন বলে জানিয়েছেন মধুসূদনবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন