মিষ্টি বা ভাজা, ঝুঁকি প্রতি গ্রাসেই

পাড়ার দোকান থেকে নিয়মিত সর্ষের তেল কিনছেন। তাই দিয়ে বছরের পর বছর আপনার হেঁসেল চলছে। কিন্তু বাজারে আসার আগে তার গুণমান কি নিয়মিত যাচাই হচ্ছে?

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

পাড়ার দোকান থেকে নিয়মিত সর্ষের তেল কিনছেন। তাই দিয়ে বছরের পর বছর আপনার হেঁসেল চলছে। কিন্তু বাজারে আসার আগে তার গুণমান কি নিয়মিত যাচাই হচ্ছে?

Advertisement

ম্যাগি-বিতর্কে সতর্ক হয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্নটা যদি দোকানিকে করেও থাকেন, জবাব না-পাওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল। বড়বাজারের যে ব্যবসায়ীর থেকে তিনি তেল কেনেন, সেই ‘হোলসেলার’ও এ বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করতে পারবেন না।

শুধু সর্ষের তেল নয়। প্রশ্ন আছে প্রতি পদেই। যে পান্তুয়া কিনে হামেশা তারিয়ে-তারিয়ে খান, তার গুণগত মান কি জানেন? জানেন কি, তাতে এমন কোনও রাসায়নিক মিশে আছে কি না, যা শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে? দোকানের পিছনে রয়েছে ফ্যাক্টরি। রোজ সেখান থেকে মাল সরাসরি দোকানের শো-কেসে চলে আসে। দোকানি জানাচ্ছেন, কখনও কেউ তাঁদের মিষ্টির মান পরীক্ষা করতে আসেনি। প্যাকেটে ভরা যে চিঁড়ে ভাজা রোজ বাড়িতে আনছেন, সেটাই বা কোন তেলে ভাজা হয়েছে? মুচমুচে রাখতে ক্ষতিকর কোনও কিছু মেশানো হয়েছে কি না, সে গ্যারান্টি কে দেবে? যে পলিথিনের প্যাকেটে ভরে এ সব বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোও কি সরকারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ?

Advertisement

দোকানিকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবেন। পাড়ার দোকানের পনীরের কথাই ধরুন। দোকানির দাবি, লোক্যাল মেড, এক্কেবারে খাঁটি। আপনি শুনেই খুশি। নিজে খাচ্ছেন, বাড়ির ছোট-বড় সকলকে খাওয়াচ্ছেন। গুণমান পরীক্ষিত কি না, সেই সংশয় শিকেয় তোলা থাকছে।

আসলে ম্যাগি-কাণ্ড ঘটে না-গেলে প্রশ্নগুলো উঠতই না। কারণ, এমন ভাবে কেউ কখনও ভাবেনি। এখন যখন প্রশ্নটা উঠছে, তখন কী দেখা যাচ্ছে?

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর, খাদ্য দফতর, ও কলকাতা পুরসভায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, খাদ্যে ক্ষতিকর বস্তু বা ভেজাল আটকাতে কড়া আইন থাকলেও তা বলবৎ করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। কেন্দ্রীয় ‘ফুড সেফটি স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট ২০০৬’ এবং ‘ফুড সেফটি রুল্‌স অ্যান্ড রেগুলেশন্‌স ২০১১’ অনুযায়ী খাবারে নিম্নমানের উপাদান বা ভেজাল দ্রব্য রয়েছে কি না, কিংবা ক্ষতিকর রং, ধাতু, অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, হরমোন ইত্যাদি মেশানো রয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য দফতরের আওতাধীন খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের। ওই পরীক্ষায় উতরোলে তবেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে খাবার বিক্রির রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স দেওয়া হয়। সেই পরীক্ষার ‘পাস’ সার্টিফিকেট খাদ্য প্রস্তুতকারীর রয়েছে কি না, মাঠে নেমে তা খতিয়ে দেখার দায় ফু়ড ইন্সপেক্টরদের। দোকান-বাজার থেকে তাঁরা যে কোনও খাদ্যদ্রব্যের নমুনা তুলে এনে পরীক্ষা করবেন, এটাই নিয়ম।

কাজটা কি যথাযথ হয়?

রাজ্যে খাদ্য-গুণমান পরীক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার (ফুড সেফটি)। রাজ্যের কমিশনার (ফুড সেফটি) গোধূলি মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ফুড সেফটি অফিসার সাকুল্যে ১৪-১৫ জন। আমরা খুব দ্রুত লোক নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ অভিযোগ, নজরদারিতে দুর্বলতার এই মওকায় পাড়ায় পাড়ায় অলিতে-গলিতে খাবার তৈরির বিস্তর ছোট ছোট সংস্থা গজিয়ে উঠছে, যাদের উপরে কর্তৃপক্ষের কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বিনা রেজিস্ট্রেশন-লাইসেন্সে তারা কারবার চালাচ্ছে। ‘‘বুঝতে পারছি যে, মিষ্টি থেকে শুরু করে মশলা, ডাল— সর্বত্র দেদার ক্ষতিকর সিন্থেটিক রং মেশানো হচ্ছে। অথচ কিছু করতে পারছি না।’’— অসহায় মন্তব্য এক ফুড সেফটি অফিসারের।

তা হলে ওঁরা করেনটা কী? ওঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘আমরা এখন বাজার থেকে দুগ্ধজাত পদার্থ আর পানীয়ের নমুনাই সংগ্রহ করি। এই লোকবল নিয়ে তার বেশি আর সম্ভব নয়।’’

খাবার পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রেরও বড় অভাব। কমিশনার বলেন, ‘‘কনভেন্ট রোডের যে ল্যাবরেটরিতে নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়, সেখানেও যন্ত্রপাতির ঘাটতি। ওরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রের তালিকা পাঠিয়েছে। আমরা ব্যবস্থা করছি।’’ ২ নম্বর কনভেন্ট লেনে স্বাস্থ্য দফতরের ওই ফুড ল্যাবের ‘ফুড অ্যানালিস্ট’ অরূপ দত্তগুপ্তের কথায়, ‘‘এখানে এখন ১০ জন কেমিস্ট আছেন। এক-এক জন মাসে ১০০-২০০ নমুনা পরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু নমুনা-ই তো আসছে না! এক মাসে মেরে-কেটে ৪০-৫০টি স্যাম্পল পৌঁছোচ্ছে।’’

মহানগরে খাবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কলকাতা পুরসভার আলাদা ফুড সেফটি বিভাগ রয়েছে। পুরসভার ফুড ল্যাবেরও প্রায় এক হাল। অর্ধেক পরীক্ষাই করা যায় না। ‘‘তার উপরে খাবারে ক্ষতিকর দ্রব্য পাওয়া গেলেও অপরাধীদের সাজা হয় না। তা হলে খামোখা নমুনা সংগ্রহ করা কেন?’’— আক্ষেপ করছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক অফিসার। পুর-তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৫-র অর্ধেক পর্যন্ত শহর কলকাতায় মাত্র ১১০টি নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। ২২টিতে অত্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান মিললেও কারও শাস্তি হয়নি। নমুনা ল্যাবেই পড়ে রয়েছে। মাস ছয়েক আগে দিল্লির পরিদর্শক দল এসে ল্যাবরেটরির বেহাল দশা দেখে বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। এক পুর-কর্তা বলেন, ‘‘ক’দিন আগে কিছু স্কুলের মিড-ডে মিলের স্যাম্পল আনা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ল্যাবে খাবারে প্রোটিন ও ফ্যাটের পরিমাণ পরীক্ষার ব্যবস্থা না-থাকায় সব ফেরত যায়।’’

এখানেই শেষ নয়। রেশনের দোকান থেকে দেওয়া চাল-চিনি- গম-আটা-মশলা ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য রাজ্যে খাদ্য দফতরের পাঁচটা যে ল্যাবরেটরি ছিল, তার চারটেই বন্ধ। শুধু মির্জা গালিব স্ট্রিটে দফতরের সদর অফিসের ল্যাবটি চালু, সেখানে রাজ্যের ৭৫টি ডিস্ট্রিবিউশন গোডাউন থেকে খাবারের নমুনা আসছে। সেখানকার কর্তারাই স্বীকার করেছেন, ডাঁই হয়ে আসা নমুনাগুলোর কোনওটাই পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।

ম্যাগি-পর্বের জেরে এখন পালে বাঘ পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে চার দিক থেকে। সামাল দিতে সরকার বা পুরসভা কতটা নড়ে-চড়ে বসে, সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন