(বাঁ দিকে) শোভন চট্টোপাধ্যায়। রত্না চট্টোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
স্বামী ফিরতেই স্ত্রীকে নিয়ে জল্পনা শুরু তৃণমূলে! এ অবশ্য হওয়ারই ছিল। শোভন চট্টোপাধ্যায় মূলস্রোতের প্রশাসন এবং রাজনীতিতে ফিরবেন আর রত্না চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা হবে না, তা তো হতে পারে না! বিশেষত, রত্না যখন এখনও তৃণমূলের বিধায়ক এবং কাউন্সিলর। শোভন-রত্নার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে একই দলে দু’জনের রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে অতএব তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
সাত বছর পরে প্রশাসনে ফিরছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শোভন। সরকারি ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ‘নিউটাউন কলকাতা উন্নয়ন পর্ষদ’ (এনকেডিএ)-এর চেয়ারম্যান হচ্ছেন তিনি। যাকে প্রশাসনে ‘রাজনৈতিক নিয়োগ’ হিসাবেই দেখা হচ্ছে। তবে এ কথা সকলেই জানেন যে, শোভনকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে রেখে দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটাননি। প্রশাসন থেকে তৃণমূলের সক্রিয় রাজনীতিতে শোভনের এসে পড়া তাই সময়ের অপেক্ষা। অবামপন্থী রাজনীতিতে নেতা বা নেত্রীর ‘ওজন’ নির্ধারিত হয় তাঁর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বের নিরিখে। সুতরাং শোভনকেও নির্বাচিত বিধায়ক হতে হবে।
শোভন ছিলেন বেহালা পূর্বের বিধায়ক। সেই কেন্দ্রে আবার এখন বিধায়ক রত্না। কিন্তু শোভনের রাজনীতি শুরু এবং তাঁর উত্থান বেহালা থেকেই। ফলে তিনি সেখানেই স্বচ্ছন্দ। রাজ্য সরকারে প্রশাসনিক দায়িত্ব পাওয়ার পরে বেহালা পশ্চিম কেন্দ্রে শোভনের ছবি সম্বলিত হোর্ডিং দেখা গিয়েছে। ওই কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি গত সাড়ে তিন বছর ধরে জেলবন্দি। আগামী নভেম্বরে তাঁর জেলমুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তিনি যে বিধানসভা ভোটে আর তৃণমূলের টিকিট পাবেন না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। সেই সূত্রেই জল্পনা তৈরি হয়েছে, শোভনকে পার্থের বেহালা পশ্চিম আসনে আসনে প্রার্থী করা হবে। কিন্তু তার পাশের বেহালা পূর্ব (যা শোভনের পুরনো কেন্দ্র) আসনে রত্না বিধায়ক হওয়ায় জটিলতা তৈরির একটা সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। শোভন-রত্নার যা পারস্পরিক সম্পর্ক, তাতে পাশাপাশি আসনে দু’জন একই দলের হয়ে লড়লেও আলটপকা কিছু কথা প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে বলে ফেলতেই পারেন। সে ‘ঝুঁকি’ নিতে চাইছে না শাসকদল। ফলে রত্নাকে বেহালা পূর্ব থেকে টিকিট না দেওয়ারই পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, রত্নাকে একেবারে ছেঁটেও ফেলা হবে না। কারণ, তাঁর সঙ্গেও মমতার সম্পর্ক খারাপ নয়। বস্তুত, মমতার বাড়ির কালীপুজোয় রত্নাকে মুখ্যমন্ত্রী এবং অভিষেকের ঘনিষ্ঠবৃত্তেই দেখা গিয়েছে। যজ্ঞের সময়ে অভিষেকের ঠিক পিছনেই বসে ছিলেন তিনি। পাশে চেয়ারে বসে ছিলেন মমতা। কালীঘাটের কে কতটা ‘ঘনিষ্ঠ’ এই ধরনের সূচকে তার মাপজোক চলে তৃণমূলের অন্দরে। সেই নিরিখে রত্নার সঙ্গে কালীঘাটের ‘দূরত্ব’ নেই। ফলে কেন্দ্র বদলালে তাঁকে ‘পুনর্বাসন’ দেওয়া হবে। শোনা যাচ্ছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা আসনে প্রার্থী করা হতে পারে রত্নাকে। ওই কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক রত্নার বাবা দুলাল দাস। ২০১১ সাল থেকে মহেশতলার বিধায়ক ছিলেন রত্নার মা তথা দুলালের স্ত্রী কস্তুরী দাস। ২০১৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হয় দুলালকে। সে বার তো বটেই, ২০২১ সালেও জিতে বিধায়ক হন দুলাল। মহেশতলার বিধায়কের পাশাপাশি দুলাল মহেশতলা পুরসভার চেয়ারম্যানও। তাঁর বয়স ৮০ পেরিয়েছে। সেই বয়সের কারণেই দুলালকে সরিয়ে রত্নাকে তাঁর মহেশতলা আসনে প্রার্থী করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। কন্যাকে আসন ছেড়ে দিতে দুলালেরও কোনও আপত্তি থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
দলের এমন ‘পরিকল্পনা’ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি রত্না। তবে তাঁর কথায় স্পষ্ট যে, আসন বদলালে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। রত্নার কথায়, ‘‘দল আমায় যেখানে কাজ করার সুযোগ দেবে, সেখানেই করব। কেন্দ্র নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। কাজ করাটাই আমার কাছে বড় কথা।’’
রত্নাকে শেষপর্যন্ত মহেশতলায় প্রার্থী করা হলে তাঁর আসন বেহালা পূর্বে প্রার্থী করা হতে পারে রাজ্যসভার এক প্রাক্তন সাংসদকে। তাঁকে বিধানসভায় বিধায়ক হিসাবে চাইছে দল। সুবক্তা হিসাবে তাঁর পরিচিতি আছে।
একটা সময়ে তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা ছিল, শোভন মূলস্রোতে ফিরুন, তা মমতা চাইলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চান না। বস্তুত, দীর্ঘ সাত-আট বছর তাঁদের দেখাও হয়নি। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎই অভিষেকের সঙ্গে একান্তে বেশ খানিক ক্ষণ বৈঠক করেন শোভন-বৈশাখী। তার পরেই শোভনের ঘরে ফেরার জল্পনা ডানা মেলতে শুরু করেছিল। উত্তরবঙ্গ সফরের সময়ে গত বৃহস্পতিবার দার্জিলিংয়ের রিচমন্ড হিলে মমতার সঙ্গে আর এক দফা বৈঠক সারেন শোভন। পরের দিন অর্থাৎ শুত্রবার শোভনকে এনকেডিএ-এর চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ করার বিজ্ঞপ্তি জারি করে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর।
তবে শোভনের প্রার্থী হওয়া-না হওয়া, রত্নার আসন বদল বা পুনর্বাসন— এই সবই এখনও তৃণমূলে পরিকল্পনার স্তরে। সঠিক সময়ে ভোট হলে এখনও পাঁচ-ছ’মাস বাকি। যা অনেকটা সময়। তৃণমূল সূত্রের খবর, রত্না সংক্রান্ত ‘পুনর্বাসন প্রকল্প’ মমতার কাছে নিয়ে ফেলা হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে তাঁর সিলমোহরের উপর।