এসআইআরের কাজের জন্য আরও কিছুটা সময় পাবেন বিএলও-রা। — ফাইল চিত্র।
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। বিজেপির বিরোধী দলগুলির তরফে বার বার অভিযোগ করা হয়েছে, যে ভাবে বিহার এবং তার পরে দেশের ১২টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে দ্রুত গতিতে এসআইআরের কাজ হচ্ছে, তা নির্ভুল হতে পারে না। সেই অভিযোগের আবহেই পিছিয়ে গেল এসআইআরের প্রক্রিয়া। কেন, তার ব্যাখ্যা কমিশন দেয়নি। কমিশনের সূত্রে খবর, কয়েকটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআর প্রক্রিয়া বিভিন্ন কারণে ধীর গতিতে চলছে। সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে কমিশন। যদিও তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলি এর নানা ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা কমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। অন্য দিকে বিজেপি-র দাবি, কমিশনের এই সিদ্ধান্তে সুবিধা হল। প্রয়োজনে আরও সময় নিয়ে করা হোক এসআইআর।
আগে বলা হয়েছিল, ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এনুমারেশন ফর্ম নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। ৯ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং ২০২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা। রবিবার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে কমিশন এই প্রক্রিয়াগুলি সাত দিন করে পিছিয়ে দিয়েছে। ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে যেখানে কমিশনের ওয়েবসাইটে ভোটারদের এনুমারেশন ফর্মের তথ্য আপলোড করার কাজ শেষ করার কথা ছিল, সেখানে তার চার দিন আগে কমিশন কেন এই সিদ্ধান্ত নিল, সেই নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
কমিশন এই নিয়ে সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। তবে কমিশনের আধিকারিকদের একটি সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআরের কাজ যতটা এগিয়েছে, ১২টির মধ্যে বাকি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে অবস্থা তেমন নয়। কেরলে ২ কোটি ৭৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৮৫৫ জন ভোটারের ৯৮.৪ শতাংশ শনিবার পর্যন্ত এনুমারেশন ফর্ম পেয়েছেন। শনিবার পর্যন্ত সেখানে ৭৩.০২ শতাংশ ভোটারদের তথ্য ডিজিটাইজ় করার কাজ শেষ হয়েছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে শনিবার পর্যন্ত ৯১.৭৭ শতাংশ ভোটারের এনুমারেশন ফর্মের তথ্য ডিজিটাইজ় করা হয়ে গিয়েছে। কমিশনের সূত্র বলছে, কেরলে এসআইআরের কাজ পিছিয়ে থাকার কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন। ৯ এবং ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভোট রয়েছে। গণনা হবে ১৩ ডিসেম্বর। সেই নিয়েই রাজ্যের নির্বাচন আধিকারিকেরা ব্যস্ত। সে কারণে তাঁরা এসআইআরে সময় দিতে পারছেন না বলে খবর।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ঘূর্ণিঝড় দিটওয়া-র প্রভাবে গত কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টি, দুর্যোগ চলছে তামিলনাড়ু এবং পুদুচেরীতে। কমিশনের একটি সূত্র বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেখানে বিএলও-রা ঘুরে ঘুরে ফর্ম বিলি এবং সংগ্রহ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। তামিলনাড়ুতে শনিবার পর্যন্ত ৯৮.৩৪ শতাংশ ভোটার এনুমারেশন ফর্ম পেয়েছেন। শনিবার পর্যন্ত ৮১.৮৪ শতাংশ ভোটারের তথ্য ডিজিটাইজ় হয়েছে। পুদুচেরীতে ওই একই সময় পর্যন্ত ৯৮.৩৯ শতাংশ ভোটার এনুমারেশন ফর্ম পেয়েছেন। শনিবার পর্যন্ত ৮৭.৮৭ শতাংশ ভোটারের তথ্য ডিজিটাইজ় হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে এনুমারেশন ফর্ম বিলির হার ভাল হলেও ডিজিটাইজ়েশনের হার খুবই কম। বিরাট এই রাজ্যে ভোটারের সংখ্যা ১৫ কোটি ৪৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৯২। শনিবার পর্যন্ত ৯৯.৭৪ শতাংশ ভোটার এনুমারেশন ফর্ম পেয়েছেন। সেখানে ওই একই সময়ে ৬০.৯১ শতাংশ ভোটারের তথ্য ডিজিটাইজ় করা হয়েছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে শনিবার পর্যন্ত ৯১.৭৭ শতাংশ ভোটারের তথ্য ডিজিটাইজ় করা হয়েছে। কমিশনের আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, ৪ ডিসেম্বর সময়সীমার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের ডিটাইজ়েশনের কাজ শেষ হবে না। সেই কথা মাথায় রেখেই সময়সীমা আরও সাত দিন বৃদ্ধি করেছে কমিশন।
কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এনুমারেশন ফর্ম জমা নেওয়া এবং কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে। তার মধ্যে বুথ ব্যবস্থাপনাও সেরে ফেলতে হবে। ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে খসড়া ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কাজ। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ১৬ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। তার পর সেই তালিকা সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ, আপত্তি কমিশনে জানানো যাবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। খসড়া তালিকার সমস্ত আপত্তি, অভিযোগ এবং দাবি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা, বিতর্কের নিষ্পত্তি করা, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে শুনানিতে (হিয়ারিং) ডাকা এবং আলোচনার সাপেক্ষে সন্দেহ দূর করার কাজ ইআরও-রা করবেন ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভোটার তালিকা ভাল করে খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত করার জন্য কমিশনের অনুমতি নিতে হবে। তার পর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি।
রবিবার কমিশন এই বিজ্ঞপ্তি ঘোষণার পরেই সরব হয় তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি। এসআইআর প্রক্রিয়া দেশে শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা অভিযোগ করছে, কয়েক মাসের মধ্যে এতগুলি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাতে কারচুপি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দলগুলি। বিএলও-দের একাংশ কাজের চাপ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বার বার জানিয়েছেন, ভোটারদের তথ্য ডিজিটাইজ় করতে অনেক সময় লাগছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও নেই। সে কারণে সময়সীমার মধ্যে এনুমারেশন ফর্ম বিলি, সংগ্রহ করে ডিজিটাইজডেশনের কাজ সম্ভব নয়। এ বার কমিশন সেই প্রক্রিয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি করায় বিএলও-দের সংগঠনের দাবি, তাদের অভিযোগে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যেও বিজেপি-র হাত দেখছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিজেপি যে লক্ষ্যমাত্রা কমিশনকে বেঁধে দিয়েছে, তা পূরণ হয়নি বলেই এ হেন পদক্ষেপ। কমিশন এই নির্দেশিকা দিয়ে আরও একবার প্রমাণ করে দিল, তারা বিজেপির হয়ে কাজ করছে। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হবে না। যতই নাড়াও কলকাঠি, নবান্নে ফের হাওয়াই চটি।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘এই জন্য বলে, ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না। কমিশন আমলাতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে চলছে। তাদের বাস্তব সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। ওই জন্য ভোলবদল করতে হচ্ছে। এই নির্দেশিকা আবার প্রমাণ করল কমিশনের পরিকল্পনা, যোগ্যতা কোনওটাই নেই।’’ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘কমিশনের আগেই বোঝা উচিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা জটিল রাজ্যে (ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনবিন্যাসের দিক থেকে) এত কম সময়ে এসআইআর করা সম্ভব নয়। আমরা প্রথম থেকে বলছি। কমিশন বোঝেনি। এই কমিশনের পরিকল্পনা বলতে কিছু নেই। এরা কাগুজে বাঘ।’’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার প্রত্যাশিত ভাবে কমিশনের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন যা ভাল বুঝেছে, করেছে। তাদের মনে হয়েছে, এসআইআর-এর সময়সীমা বাড়ানো দরকার ছিল, তারা বাড়িয়েছে। এতে আমাদের আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। আমরা বরং বলছি, প্রয়োজন হলে সময়সীমা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হোক। দরকার পড়লে দু’বছর সময় নিয়ে এসআইআর করা হোক। তার পরে ভোট হোক।’’ সুকান্ত এখানেই থামেননি। সে রকম পরিস্থিতি এলে কী হবে, তা-ও বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সে ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে রাজ্য রাষ্ট্রপতি শাসনে থাক। তার পরে যখন এসআইআর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, তখন রাজ্যকে রাষ্ট্রপতি শাসনে রেখেই ভোট হোক। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’ রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় জানান, কমিশনের এই সিদ্ধান্তে আখেরে লাভ হবে। তিনি বলেন, ‘‘গত তিন দিনে এক কোটি এনুমারেশন ফর্ম ডিজিটাইজ়ড করেছে বিএলও-রা। যা অত্যন্ত সন্দেহজনক। যে ১৩ জন বিশেষ পর্যবেক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা এই হঠাৎ করে তুন করে যাচাই করবেন, এটা আমাদের দাবি। সময় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই কাজে সুবিধা হবে।’’
অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গে এসআইআরের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। এসআইআর কী ভাবে চলছে, তা দেখার জন্য জ্ঞানেশ কুমারকে পুরো দল নিয়ে রাজ্যে আসতে বললেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘জ্ঞানেশ কুমার নিজের পুরো টিম আনুন। যাঁরা এসআইআরের সমালোচনা করছেন, রাহুল গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী-সহ সকলকে নিয়ে আসুন। আর প্রথমেই অধীর চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে চা খান। দেখুন কী ভাবে মুর্শিদাবাদ জেলায় এসআইআর চলছে। বাবা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে, শ্বশুর বাবা হয়ে যাচ্ছে, মায়ের চেয়ে মেয়ের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই পুরো পরিস্থিতি দেখার জন্য মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের উচিত পশ্চিমবঙ্গে আসা।’’