আইনকে তুড়ি, দেদার বিকোচ্ছে কুচো ইলিশ

ধরা বারণ। বিক্রি করা, পরিবহণ কিংবা কাছে রাখাই আইনত নিষিদ্ধ। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি, সেই সঙ্গে জরিমানা।অথচ কোথায় আইন! প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে, পুলিশকে এক রকম বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে জলের রূপালী ফসল ছোট ইলিশ।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৬ ০২:১০
Share:

১০০-১৫০ টাকা কেজি। গোয়ারিবাজার ছেয়ে রয়েছে কুচো ইলিশ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ধরা বারণ। বিক্রি করা, পরিবহণ কিংবা কাছে রাখাই আইনত নিষিদ্ধ। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি, সেই সঙ্গে জরিমানা।

Advertisement

অথচ কোথায় আইন! প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে, পুলিশকে এক রকম বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে জলের রূপালী ফসল ছোট ইলিশ। প্রশাসন দেখেও দেখছে না। অথবা স্রেফ আড়াল করছে মুখ।

যার ফলে বড় ইলিশের পাশাপাশি ছোট ইলিশও ধরা হচ্ছে অবাধে। খানিক বাজার ঘুরলেই সে ছবি স্পষ্ট। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের গোয়ারিবাজার থেকে শুরু করে আমিনবাজার কিংবা পাত্রবাজারে, সর্বত্রই বিকোচ্ছে ছোট ইলিশ। অথচ স্থানীয় লোকজনই জানাচ্ছেন, ইলিশের মরসুম শুরু হওয়ার পর থেকে এক দিনও বাজারগুলোতে অভিযান চালায়নি মৎস্য দফতর। খতিয়ে দেখেনি কী পরিস্থিতি।

Advertisement

ছোট ইলিশ ধরা বা বিক্রির বিষয়ে ঠিক কী নির্দেশিকা রয়েছে?

নদিয়া জেলা মৎস্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, ২৩ সেন্টিমিটারের (প্রায় ৯ ইঞ্চির) ছোট ইলিশ মাছ ধরা যাবে না। শুধু ছোট ইলিশ ধরাই নয়, বিক্রি করা থেকে শুরু করে কাছে রাখা কিংবা পরিবহণও নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানা এবং শাস্তি দুই-ই হতে পারে।

তবে জেলার বিভিন্ন বাজারে ছোট ইলিশ বিক্রি হলেও মৎস্য দফতর ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

এর উত্তরে নদিয়ার ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অব ফিসারিজ’ অমলেন্দু বর্মন বলেন, “ইলিশের মরসুম শুরু হতেই জেলার ভাগীরথী লাগোয়া বিভিন্ন ব্লকে মৎস্যজীবীদের মধ্যে ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ করার বিষয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। তা ছাড়াও সচেতনতা বাড়াতে বাজারগুলোতে বিলি করা হচ্ছে লিফলেট।’’ তবে বাজারগুলোতে অভিযান চালানোর মত লোকবল তাঁদের নেই, জানিয়ে দিয়েছেন অমলেন্দুবাবু।

মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ষাকালে গভীর সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মিষ্টি জলের দিকে ডিম পাড়তে ছুটে আসে। এক সময় সমুদ্রের মোহনা ছাড়িয়ে ইলিশ ভাগীরথী নদী হয়ে লালগোলা পর্যন্ত চলে আসতো। কিন্তু সেই ইলিশ আসা ধীরে ধীরে কমে গিয়েছে। মোহনাতে ঢোকার মুখেই মৎস্যজীবীদের জালে বন্দি হচ্ছে তারা। ফলে নদিয়ার দিকে ভাগীরথীতে ইলিশ খুব কমই ধরা পড়ে। দিঘা বা ডায়মন্ডহারবারের ইলিশ নদিয়ার বাজারগুলোতে ঢুকছে। সে কথা জানালেন কৃষ্ণনগরের গোয়ারিবাজারের এক পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীও। বললেন, ‘‘আমাদের কাছে দিঘা ও ডায়মন্ডহারবারের পাইকাররা বড় মাছের পাশাপাশি ছোট ইলিশও পাঠান। আর তার পর ব্যবসায়িক স্বার্থেই আমাদের বড় ইলিশের পাশাপাশি ছোট ইলিশও বিক্রি করতে হয়।’’

তবে আইনকে তুড়ি মেরে এ ভাবে ছোট ইলিশ ধরার পিছনে আরও একটা কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে ভাত-পাতে এর চাহিদা।

কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা আনন্দ বিশ্বাসের কথায়, “এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার টাকার ওপরে। সেখানে ছোট ইলিশ কেজি পিছু ২০০-২৫০ টাকায় মিলছে। ফলে যাঁদের পকেটের জোর কম, তাঁরা কম দামে ছোট ইলিশের দিকে ঝুকছেন।

কী বলছে মৎস্যজীবীদের রাজ্য সংগঠন?

‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিসারম্যান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সহ-সম্পাদক তথা ‘দিঘা ফিসারম্যান অ্যান্ড ফিস ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক শ্যামসুন্দর দাসের কথায়, “আমরা আন্তরিক ভাবে চাই ইলিশ-সহ অন্যান্য ছোট মাস ধরা বন্ধ হোক। কিন্তু অনেক সময় মৎস্যজীবীদের জালে ছোট মাছ চলে আসছে। সেগুলি সমুদ্রে ফেলে দিলেও বাঁচবে না।” কিন্তু তা বলে এত পরিমাণ! তিনি জানান, ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে ৯০ মিলিমিটারের ফাঁসযুক্ত জাল ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। আবার অন্যান্য মাছ ধরার ক্ষেত্রে ৪০ মিলিমিটার ফাঁস-যুক্ত জাল ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যান্য মাছ ধরার জালে অনেক ইলিশ উঠে যাচ্ছে।

শ্যামসুন্দরবাবুর দাবি, ছোট মাছ ধরা বন্ধ করতে হলে মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়সীমা বাড়াতে হবে। বর্তমানে ইকোনোমিক জোনে (সমুদ্রের ১২ নটিক্যাল মাইল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) কেন্দ্রীয় সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত মাত্র দু’মাস যে কোনও মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তা ছাড়াও, সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এবং রাজ্যের নদীগুলিতে জুন মাস থেকে অগস্ট মাস পর্যন্ত দুমাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ (রাজ্য সরকারের নিয়ম অনুযায়ী)। শ্যামসুন্দরবাবুর বক্তব্য, ছোট মাছ ধরা বন্ধ করতে হলে, কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয়কেই দু’মাসের জায়গায় চার মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তবেই ছোট ইলিশ-সহ যে কোনও ছোট মাছ ধরা বন্ধ করা যাবে।

অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির পাত থেকে হয়তো হারিয়েই যাবে ইলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন