bengali festival

উছলে ওঠা আবেগে বাঙালির আপ্যায়ণের ভাগ পায় তুতোজামাইরাও

সকাল থেকেই বাড়িতে চার জামাই। বড়দার দুই মেয়ে, মেজদার এক মেয়ে। তাই তিন ভাইঝি-জামাই।

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

মাছটা ভাল হয়নি, না !

Advertisement

ছি ছি, কী যে বলেন সেজমামা! এত বড় সাইজের টাটকা তোপসে আমাদের ও দিকে তো ওঠেই না! আর মেজমাইমা যা ফ্রাই করেছেন… আহা!

বড় ঘেরের সাদা ধবধবে পাজামার উপর ঘি-রঙা পিরান চাপানো দক্ষিণ কলকাতার সেজমামা— বিশ্বনাথ বাঁডুজ্জে, ডেনিম জিনস আর টি-শার্ট শোভিত উত্তর কলকাতার খুড়তুতো ভাগ্নি-জামাইয়ের পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বললেন, তবে আর একখানা নিলেই তো পারতে! তোমরা আজকালকার ছেলেপুলেরা একদম খেতে পারো না কেন বলো তো!’

Advertisement

এই জামাই ইঞ্জিনিয়ার। কথায় কথায় বিদেশে ট্যুর করতে চলে যায়। মুখের ছাঁদের সঙ্গে পুরনো দিনের হিরো অনিল চট্টোপাধ্যায়ের আশ্চর্য মিল আছে। এরা মেপে খায়, মেপে ঘুমোয়। আর বিশ্বনাথবাবুর এই দুঃখটা সাজে, কারণ বাড়িতে জামাইবাবাজিরা আসবেন বলে উনি দু’দিন আগে থাকতে পুরনো বাজারের কমল সাহাকে মালাইকারির জন্য দাঁড়া-নাড়ানো জাম্বো গলদা, ফ্রাই আর কালিয়া করার জন্য সুলেমান আলিকে টাটকা তোপসে আর খাবি-টানা দেশি ভেটকি এবং অম্বলের জন্য নব মান্নাকে বাছাই করা ঝকঝকে মৌরলা আনার বায়না দিয়ে রেখেছিলেন। ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ যেমন টলটলে কোনও হ্রদের ধারে, জল খেতে এসে দলছুট হওয়া বুনো জেব্রার বাচ্চাকে ধরার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে থাকে, আজ ভোর সাড়ে ছটা থেকে দু’রঙের দু’খানি নাইলনের ব্যাগ হাতে করে মাছবাজারে ঢোকার ঠিক মুখের কাছটায় উনিও তেমনই ঘাপটি মেরেই দাঁড়িয়েছিলেন। মাছওয়ালারা বাজারে ঢুকতেই উনিও তৎক্ষণাৎ তাদের ঝুড়ি-ঝোড়া লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারপর ব্যাগে পছন্দসই মাছ ভরে, চেনা মাছকুটুনিদের দিয়ে কাটিয়ে-কুটিয়ে, অন্য টুকিটাকি বাজার সেরে সোজা হাজির হয়েছেন বাড়িতে। ব্যাগসুদ্ধু ধরে দিয়েছেন বড়বউদি, মেজবউদির কাছে। যাঁরা দু’জনেই সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। ছোট ভাইকে এই আটান্ন বছর বয়সে এখনও শাশুড়ির হাত থেকে লাল ফ্রিল-দেওয়া তালপাতার হাতপাখায় মৃদুমন্দ হাওয়া খেতে খেতে হাসিহাসি মুখে ‘বাটা’ নেওয়ার জন্য চন্দননগরে যেতে হয়। তাই এই দিনটায় ছোটবউমাকে পাওয়া যায় না। তা নইলে তার হাতের খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি আর ছানার পায়েস বলতে গেলে ভারতবিখ্যাত।

এ দিন সকাল থেকেই বাড়িতে চার জামাই। বড়দার দুই মেয়ে, মেজদার এক মেয়ে। তাই তিন ভাইঝি-জামাই। বিশ্বনাথবাবুর নিজের বোন, তাঁর কত্তাকে নিয়ে গত তিন বছর আসতে পারেননি। তখন তাঁর জামাই ছিল মধ্য জৈষ্ঠে ওঠা বারুইপুরের নতুন লিচুর মতোই নবীন। এ বার সেই ভাগ্নিজামাই একটু পুরনো হতে বিশ্বনাথবাবু বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে তাদেরও এ বাড়িতে ষষ্ঠী উপলক্ষে নেমন্তন্ন করেছেন। তাদের বাড়ি ঢাকুরিয়ায়। এ ছাড়া ওই খুড়তুতো ভাগ্নি-জামাইকেও তাদের বেলেঘাটার বাড়িতে নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছেন।

খুড়তুতো ভাগ্নি-জামাই ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পেরেছেন তো! এর মানে হল খুড়তুতো বোনের যে মেয়ে, তার জামাই। খুব একটা নিকট সম্পর্ক মনে হচ্ছে কি? উঁহু, তা তো নয়। অন্তত এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে এক জন সাধারণ রিটায়ার্ড চাকুরে বিশ্বনাথবাবু এ বছর নিজের ইচ্ছেয় সব কিছু খরচ করছেন, দাদা বা ভাইদের খরচের হিসেবে ঢুকতে দেননি, কারণ রিটায়ার করে হাতে বেশ কিছু থোক টাকা পেয়েছেন। আর এরাই তো তাঁর সব। আর বিশ্বনাথবাবু বিয়ে-থাও করেননি। তাঁরা এখনও চার ভাই মিলে একই সংসারে থাকেন। তাঁদের মতো এখনও অধিকাংশ বাঙালির চোখেই নিজের মেয়ে-জামাই, ভাইঝি-জামাই, নিজের ভাগ্নি-জামাই, থুড়ি খুড়তুতো ভাগ্নি-জামাইও কিন্তু সমান আদরের। এদের প্রত্যেককেই জামাইষষ্ঠীর মতো একটি আশ্চর্য এবং এক্সক্লুসিভ পার্বণে ডেকে এনে খাওয়ানো উচিত। মনোহর জামাকাপড় বা প্রিয় কোনও উপহার হাতে তুলে দেওয়া উচিত।

আসলে সারা পৃথিবীটাই যখন আজ এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে নিজের বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করে, এক ধরনের একলষেঁড়ে স্বার্থপর মানুষের জীবন কাটাতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তখন বাঙালি নামক একটি লুপ্তপ্রায় জাতির কিছু মানব-মানবী, পরকে আপন এবং আপনতর করে নেওয়ার জন্য জামাইষষ্ঠীর মতো কিছু সু-আচার এখনও যে বুকে করে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, এর কোনও তুলনা সারা পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই। বিদেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের বেশির ভাগ জায়গাতেই এখন কেউ কাউকে কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁয় খেতে আমন্ত্রণ জানালে, পরের দিন সকালে হোটেল থেকে সেই আমন্ত্রিত মানুষটির কাছে গত সন্ধ্যার খাওয়ার বিল পৌঁছে যায়।

যিনি আমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তা মেটান না। এমনকী নিজের বাবা-মা, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-স্বজন সকলের জন্যই নাকি ব্যাপারটি সমান সত্যি। এখন উন্নত পৃথিবীর খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গিই হল— যে যার, সে তার, আমি কার, কে তোমার! এর মধ্যে নাকি কোনও লজ্জা নেই, কুণ্ঠাও নেই। কাজেই এর উলটো দিকের আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা একটি দরিদ্র দেশের একটি দরিদ্র জাতি, শত অসুবিধে এবং টানাটানির মধ্যেও যে জামাইষষ্ঠীর মতো একটি পার্বণে, ভাগ্নি-জামাই বা ভাইঝি-জামাইদের আদর করে বাড়িতে ডেকে এনে, খোসা ছাড়ানো হিমসাগরকে ফ্রিজে ঘণ্টাখানিক ঠান্ডা করে, তার উপর কনডেন্সড মিল্ক ছড়িয়ে, কাঁটা বিঁধিয়ে আপ্যায়ন করছেন— এ তো সত্যিই অভাবনীয় এবং অপূর্ব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন