শ্রীজাত।—ফাইল চিত্র।
‘আমরা থাকতে আপনার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগবে না। প্রয়োজনে সারা রাত আপনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকব।’ আমার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে কথাটা যিনি বললেন, তিনি এক শীর্ণ প্রৌঢ়া, শিলচর নিবাসী। সাদামাটা শনিবারের সন্ধেয় এসেছিলেন অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকতে। মুহূর্তে রক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাঁর এতটুকু দ্বিধাবোধ হয়নি।
গিয়েছিলাম একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্বোধনে, শিলচর শহরে, ১২ জানুয়ারি। যাবার দিন সকাল পর্যন্ত কোথাও কোনও অসুবিধের আঁচ ছিল না। আমি শিলচরে নামার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ বা কারা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন এই মর্মে যে, আমাকে শিলচর শহরে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না। সার্কিট হাউস ঘেরাও করার কথাও ঘোষণা করা হয়, যেখানে আমি ছিলাম। সন্ধের মুখে গোপনে সার্কিট হাউস থেকে উদ্যোক্তারা আমাকে নিয়ে আসেন হোটেলে, যেখানে অনুষ্ঠান হবার কথা।
অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে শুরু হলেও, মিনিট চল্লিশের মাথায় বেশ কয়েক জন বহিরাগতকে লক্ষ করি, যাঁরা এক রকম গা-জোয়ারি করেই মঞ্চে উঠে আসেন। আয়োজকরা তাঁদের শান্ত হতে বলায় তাঁরা শোনেন না এবং সঞ্চালকের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে আমাকে একটি বিশেষ কবিতার একটি বিশেষ পংক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেন। তত ক্ষণে অনুষ্ঠানের মেজাজ প্রায় নষ্ট। আমি কোনও উত্তর দেবার আগেই দর্শকাসন থেকে অনেকে প্রতিবাদ জানান। তখন শুরু হয় তুমুল চাপানউতোর। অবস্থা যা দাঁড়ায়, তাতে যে-কোনও মুহূর্তে আমার উপর আক্রমণ নেমে আসতে পারে।
আমি মঞ্চেই বসে তখনও। পাঁচ হাতের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা, চিৎকার, ধস্তাধস্তি চলছে। আমাকে কোনও দিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার উপায় নেই। সেই মুহূর্তে, ঘরের মধ্যে যত জন মহিলা ছিলেন, আঠারো হোন বা সত্তর, হাতে হাত বেঁধে ঘিরে নেন আমাকে। নাম-না-জানা শীর্ণ সেই মানুষটি, যাঁকে ‘মাসিমা’ বলেই ডাকা উচিত আমার, দু’হাত চেপে ধরে আশ্বাস দেন। ছোট ছোট মেয়েরা, স্কুলের শেষ দিকে বা সদ্য কলেজ হয়তো, আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে নিয়ে টানটান বৃত্ত তৈরি করে ফেলেন চোখের পলকে। তাঁদের পেরিয়ে তখন আর চোখ যাচ্ছে না সামনের ঘটনার দিকে, কিন্তু চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে। আর তাঁরা, সেই বেষ্টনী সৃষ্টিকারী মেয়েরা আমাকে বলছেন, ‘আপনি বসে থাকুন। আমাদের গায়ে হাত না-দিয়ে আপনাকে ছুঁতে পারবে না কেউ।’ ওই চরম বিপদের কেন্দ্রে বসেও আমার মাথা নত হয়ে আসছে এই আশ্চর্য ভালবাসার সামনে, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে যার চেয়ে বড় অস্ত্র আজ আর কিছু নেই।
এর পর কোনও ক্রমে সেই সমস্ত বহিরাগতদের ব্যাঙ্কোয়েট হলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু আমি এবং আমার সঙ্গে বহু শিলচরনিবাসী মানুষ এক রকম বন্দি হয়ে পড়ি ঘরের মধ্যে। মহিলাদের বেষ্টনী আলগা কিছুটা, যদিও তাঁরা আমাকে ঘিরে রাখেন সারাক্ষণ। বাইরে তখন আমার নামে প্রবল তিরস্কার-বাক্য এবং ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনি উঠছে। বুঝতে পারছি, বহু মানুষ শামিল হয়েছেন সেই বিক্ষোভে। এ জিনিস সহজে নিভবে না।
আরও পড়ুন: অসহিষ্ণুতার হানায় উদ্বেগে বিশিষ্টরা
নিভে গেল অবশ্য হোটেলের আলো। নিভিয়ে দেওয়া হল কি না, জানি না। ইটপাটকেল ছোড়া শুরু হল বাইরে থেকে। কাচ ভেঙে ফেলা হল বেশ কিছু। দু’একবার গায়ের জোর খাটিয়ে ব্যাঙ্কোয়েট হলেও ঢোকার চেষ্টা চালালেন কিছু মানুষ, কিন্তু ভিতরের মানুষজনের প্রতিরোধে তা সম্ভব হল না। উন্মত্ত জনতার আক্রোশের আওয়াজে তখন গোটা এলাকা কাঁপছে। ভিতরে ঢুকে আসেন যদি তাঁরা, কী হবে, কেউ জানে না।
এই রকম অবস্থায় তিন ঘণ্টার কাছাকাছি কাটল। আমি তখন ভাবছি, এ যাত্রায় ফেরা আছে কি না, কে জানে। আর কেবলই মনে হচ্ছে, যদি না-ই হয় ফেরা, তাই ব’লে, এ ভাবে একটা ঘরে বন্দি হয়ে কিছু মানুষের রোষের কাছে হেরে যেতে হবে?
শেষমেশ অবশ্য হয়নি তা। অসম প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তারা এসে পড়েন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তিন গাড়ি সিআরপিএফ-এর কনভয়ে আমাকে ও আয়োজক সব্যসাচীকে পৌঁছে দেওয়া হয় সার্কিট হাউসে, চারপাশে কড়া প্রহরা বসে।
আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের ফোন আসতে শুরু করে, সংস্কৃতিমহলের অগ্রজ, বন্ধু বা অনুজদের সমর্থন জানতে পারি। ফোন করে বিশদ খোঁজ নেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিলচরে বাকি রাতটুকু এবং ফেরার পর কলকাতায় আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না, এই আশ্বাসও দেন। কাকভোরে সশস্ত্র প্রহরায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিমানবন্দরে, বেলার দিকে কলকাতার বাড়িতে ঢুকি, তা-ও কনভয়ের ঘেরাটোপে।
দু’চার লাইন লিখতে এসে এই জীবন চেয়েছিলাম বুঝি? নাকি চেয়েছিলাম এই দেশ? তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও আলো তাঁরাই, যাঁরা কাছে-দূরে পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমাদের সম্বল এখন শঙ্খ ঘোষের সেই পংক্তিমালা ‘কিছুই কোথাও যদি নেই/তবু তো কজন আছি বাকি/আয় আরো হাতে হাত রেখে/আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’। এই শেষ জোরটুকু যেন আমাদের ছেড়ে না-যায় কখনও।