সরকারি আধিকারিকদের কাজের অগ্রগতির খতিয়ান দিতে হবে অ্যাপের মাধ্যমে। —গ্রাফিক আনন্দবাজার অনলাইন।
দফতরের ঠান্ডা ঘরে বসে সরকারি কাজের অগ্রগতি সংক্রান্ত রিপোর্ট আর জমা দিতে পারবেন না আধিকারিকেরা। সশরীরে তাঁদের যেতে হবে মাঠে-ময়দানে। ‘ফাঁকিবাজি’ ধরতে নতুন অ্যাপ আনছে রাজ্য সরকার। এই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে অর্থ দফতর। সেই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে নবান্ন ইতিমধ্যে একটি হেল্প ডেস্কও তৈরি করেছে। জেলাগুলির ব্লক এবং মহকুমা স্তর থেকে যে তথ্য আসবে রাজ্য সরকারের কাছে, তা তদারকি (‘মনিটর’) করবে ওই ডেস্ক।
বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যে এলাকায়, যে কাজ পরিদর্শনে যাবেন আধিকারিকেরা, সেই প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয় ‘জিও ট্যাগিং’ থাকবে। যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ঘরে বসে আধিকারিকদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার দিন শেষ হতে চলেছে। নবান্নের আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, ব্লক, মহকুমা এমনকি, জেলার প্রশাসনিক স্তরেও এমন কিছু আধিকারিক রয়েছেন, যাঁরা কাজের অগ্রগতির বিষয়ে নিজেরাও ওয়াকিবহাল থাকেন না। ফলে সরকারও জানতে পারে না, যেখানে যে কাজ শুরু হয়েছে, তা কতটা এগোল। এর ফলে পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো কাজ চলে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারের সর্বোচ্চ স্তর মনে করছে, প্রশাসনিক স্তরে যত্নের অভাবেই সরকারি কাজ শুরু হলেও তা দেরিতে শেষ হচ্ছে। নবান্ন সেটাই রুখতে চাইছে।
অন্য একটি কারণের কথাও বলছেন আধিকারিকদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, শাসকদলের একটি অংশ মনে করে সরকারি কাজে আমলাদের শ্লথতার জন্য ‘ফলো আপ’ প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে হচ্ছে না। ফলে মানুষ সময়ের পরিষেবা সময়ে পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক ভাবে যার ‘নেতিবাচক প্রভাব’ গিয়ে পড়ছে শাসকদলের উপরেই। তৃণমূলের এই অংশ মনে করে, আমলারা ভোট করেন না। ভোট করে দল। কিন্তু তাঁদের কাজের জবাবদিহি করতে হয় দলের নিচুতলার কর্মীদের। প্রশাসনিক মহলের অনেকের বক্তব্য, সেই বিষয়টিকে মান্যতা দিয়েই অ্যাপ তৈরির পথে হাঁটছে রাজ্য সরকার।
অর্থ দফতরের নির্দেশিকার পাশাপাশি ২২ পাতার পদ্ধতি সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকাও আধিকারিকদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে নবান্ন। সেখানে লেখার সঙ্গে মোবাইল স্ক্রিনের ছবি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, কী প্রক্রিয়ায় কাজ করতে হবে। বিডিও, এসডিও, জেলাশাসক থেকে প্রতিটি দফতরের আধিকারিকের মোবাইল নম্বর দিয়ে অ্যাপে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। যে রিপোর্ট তাঁরা অ্যাপে পূরণ করবেন, তা নিশ্চিত করতে হবে ছয় সংখ্যার ওটিপি-র মাধ্যমে। কোনও কাজ শুরুর আগে যেমন সমীক্ষা রিপোর্ট পাঠাতে হবে, তেমনই কাজ শুরু হলে নির্দিষ্ট সময়ান্তরে তা পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিতে হবে সরকারকে। যে কাজ হচ্ছে, তার ছবিও তুলে ‘আপলোড’ করতে হবে আধিকারিকদের।
মোদ্দা কথা, সরকার আর আধিকারিকদের কাছে কাজের অগ্রগতি সংক্রান্ত রিপোর্ট চাইবে না। আধিকারিকদেরই সক্রিয় হয়ে সেই কাজ করতে হবে। গোটাটাই হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ধরা যাক, কোনও একটি রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। আধিকারিকদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর জানাতে হবে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। থাকলে তা কেমন? সাধারণ সমস্যা নাকি জটিল? একই ভাবে বিদ্যুৎ, পরিচ্ছন্নতা, পানীয় জল-সহ জনজীবনের প্রাত্যহিক বিষয়গুলিও থাকছে। দফতরভিত্তিক ক্ষেত্র আলাদা করে দেওয়া থাকবে অ্যাপে। সেই অনুযায়ী তথ্য দিতে হবে আধিকারিকদের।
গত কয়েক বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী একাধিক প্রশাসনিক বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন সরকারি কাজে নজরদারির অভাব নিয়ে। কাজ শুরু হলে মাঝপথে তা থমকে যাওয়া, সে ব্যাপারে সরকারকে অবগত না-করা নিয়ে ক্ষোভ গোপন করেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রশাসনিক মহলের অনেকের বক্তব্য, বার বার বলেও আধিকারিক এবং আমলাদের একাংশকে ‘সোজা’ করতে পারছিল না নবান্ন। এ বার তাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ভাবে নজরদারির প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইছে নবান্ন। উল্লেখ্য, বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতকারী সংস্থা, ওষুধ কোম্পানি, প্রসাধনী বা বিভিন্ন দ্রব্যের সংস্থার বিপণন বিভাগের কর্মীদের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা অ্যাপ রাখে। যাতে তাঁরা ঘরে বসে বাজার ঘোরার রিপোর্ট না-দিতে পারেন। সেখানেও থাকে জিও ট্যাগিংয়ের বন্দোবস্ত। খানিকটা সেই ধাঁচেই সরকারি কাজে নজরদারির প্রক্রিয়া শুরু করতে চলেছে রাজ্য সরকার।