প্রতীকী ছবি।
জনজাতিভুক্ত মানুষদের স্বার্থে রাজ্যে একাধিক সরকারি প্রকল্প চালু থাকলেও তাঁদের কাছে তার সুফল কতটা পৌঁছচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় উস্কে দিল প্রতীচী ইনস্টিটিউট ও এশিয়াটিক সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে করা একটি সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট।
সোমবার এশিয়াটিক সোসাইটি হলে ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেন প্রতীচীর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। অবিভক্ত মেদিনীপুর, বর্ধমান, ও জলপাইগুড়ি, এবং পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, দার্জিলিং, বীরভূম, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা ও মালদহ জেলায় এক হাজার জনজাতি পরিবারের মধ্যে চালানো ওই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ৩১ শতাংশ গত এক বছরে নানা মাত্রার খাদ্যাভাবে ভুগেছেন। বেশির ভাগেরই আমিষ বা ডাল জাতীয় খাবার প্রায় জোটেই না। ফলে যাঁদের সরাসরি খাদ্যাভাব নেই, তাঁদেরও যথেষ্ট পুষ্টি মেলে না। সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর। কিন্তু এই সমীক্ষা অনুসারে জনজাতিভুক্ত মানুষের গড় আয়ু ৫৮।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে জনজাতিভুক্ত মানুষ সমাজের অন্যান্য অংশের মতো একই রকম আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। কিন্তু সুযোগ ও সামর্থ্যের অভাব তাঁদের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন, শিক্ষার অধিকার আইনে এক কিলোমিটারের মধ্যে স্কুলের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও জনজাতি পরিবারগুলির আট শতাংশ ছাত্রছাত্রীকে প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার জন্য এক কিলোমিটারের বেশি হাঁটতে হয়। তা সত্ত্বেও ৯৪ শতাংশ শিশু স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আবার, ৬১ শতাংশ মানুষ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা দাবি করলেও ৩৯ শতাংশকে নির্ভর করতে হয় হাতুড়ে ডাক্তারদের উপরে। মাত্র ১৯ শতাংশ প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। সাকুল্যে তিন শতাংশ যান বেসরকারি হাসপাতালে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাব থাকায় বেশির ভাগ পরিবারই তার সুযোগ ঠিকমতো নিতে পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ৫৪টি প্রসব হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
শিশুদের টিকাকরণের ক্ষেত্রেও খামতির খবর দিচ্ছে সমীক্ষার রিপোর্ট। এক বছরের বেশি বয়স, এমন ৫২টি শিশুর মধ্যে মাত্র ৩৬টি শিশুর কাছে টিকাকরণের কার্ড মিলেছে। তার মধ্যে মাত্র ৫৮ শতাংশের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে।
তিন ভাগের দু’ভাগ বাড়িতে কোনও ধরনের নর্দমা নেই। অর্ধেক বাড়িতে শৌচাগার নেই। যে-সব বাড়িতে সমীক্ষা চালানো হয়েছে, সেখানে লোধা সম্প্রদায়ের কারও বাড়িতে শৌচাগার মেলেনি।
দারিদ্র খুব বড় সমস্যা। এক-চতুর্থাংশের নিজস্ব কোনও জমি নেই। যাঁদের জমি আছে, তাঁদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই প্রান্তিক চাষি। বেশির ভাগই দিনমজুরি করেন। ৫৩ শতাংশকে কৃষি ছাড়া অন্য কোনও উৎস থেকে আয়ের উপরে নির্ভর করতে হয়।
জনজাতির মানুষ আগে প্রকৃতি থেকে সরাসরি যে-সব খাদ্য ও জ্বালানি সংগ্রহ করতেন, বনজঙ্গল ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি কারণে তা অনেক কমে গিয়েছে। পাশাপাশি, নিজের নিজের এলাকায় কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার সম্প্রতি অনেকেই কাজের খোঁজে দূরবর্তী রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
আইনে জনজাতির মানুষকে কী অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে সচেতন মাত্র ১৪ শতাংশ পরিবার। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জনজাতিদের অনগ্রসরতাকে সমস্যা হিসেবে না-দেখে বরং তাঁদের সহনাগরিক হিসেবে দেখা দরকার। আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং জঙ্গলের উপরে জনজাতিদের অধিকারের ক্ষেত্রগুলি নিয়ে কাজ করলে দ্রুত পরিস্থিতির বদল ঘটানো সম্ভব।
বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থার তারতম্য আছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে স্বীকার করে পরিকল্পনা তৈরির কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। এর পাশাপাশি অমর্ত্যবাবু বলেন,‘‘সমস্যার ভিন্নতা থাকলেও তার অখণ্ডতা বোঝা দরকার। ভিন্নতা থেকে যে-দুর্বলতা আসে, তা সরিয়ে কী ভাবে সামগ্রিক প্রয়োজন মেটানো যায়, তা-ও দেখতে হবে। সেই জন্য গবেষণা খুব গুরত্বপূর্ণ।’’
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, এই রিপোর্ট প্রাথমিক। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মাস তিনেকের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৫৩ লক্ষ জনজাতির মানুষ বাস করেন। সমীক্ষা চালানো হয়েছে ১০০০ পরিবারের মধ্যে। নমুনার সংখ্যা যথেষ্ট কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। রিপোর্ট সম্পর্কে যে-কোনও রকম সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ।