নভেম্বর, ২০১৪-র আলিপুর থানা। প্রাণ বাঁচাতে ফাইলই ভরসা।—ফাইল চিত্র।
নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে যে ঘটনা ঘটল, তার শুরুটা কোথায়? বিরোধীদের মতে তার পথ দেখিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী।
যে কায়দায় মঙ্গলবার রাতে ওই ফাঁড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনা দুই তৃণমূল কর্মীকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হল তাতে ভবানীপুর কাণ্ডের কথাই মনে পড়ছে বিরোধীদের অনেকের। ২০১১-র নভেম্বরে শব্দবাজি ফাটিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোয় শোভাযাত্রা করার অভিযোগে আটকদের ছাড়াতে ভবানীপুর থানায় থানা গেড়ে বসেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আটক ওই যুবকদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু, মঙ্গলবার রাতে ভক্তিনগর থানার নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল শাসক দল। অভিযোগ, ওই ফাঁড়িতে ঢুকে পুলিশের সামনে মারধর করা হয় সিপিএম কর্মীদের। বাদ যাননি পুলিশকর্মীরাও। তার পরে দুই তৃণমূল কর্মীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। আইএনটিটিইউসি নেতা বিজন নন্দী ওরফে জনের নেতৃত্বেই ওই হামলা চালানো হয় বলে সিপিএমের অভিযোগ। ঘটনায় আহত হয়েছেন পুলিশের এক এসআই-সহ আরও কয়েক জন পুলিশ কর্মী।
ভবানীপুর থেকে ভক্তিনগর— গত চার বছরে রাজ্যে একের পর এক জায়গায় থানায় ঢুকে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি, পুলিশকর্মীদের পেটানোর অভিযোগও উঠেছে। যেমন, ২০১৪-র ১৯ জুলাই খয়রাশোলের লোকপুরে পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে মারধর এবং ভাঙচুর চালানো হয়। অভিযুক্ত তৃণমূল। ওই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর বোলপুর থানায় দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বীরভূমের প্রাক্তন জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ। এর পর ১৪ নভেম্বর, ২০১৪। কলকাতার আলিপুর থানায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে থানার ভিতরেই টেবিলের তলায় সেঁধিয়ে পড়েন পুলিশকর্মীরা! শুধু তাণ্ডব নয়, থানায় আটক করে রাখা চার মহিলা-সহ ১৪ জন অভিযুক্তকেও ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে হামলাকারীরা। এমন উদাহরণ মোটেই বিরল নয়।
শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে আহত পুলিশকর্মীকে দেখেতে অশোক ভট্টাচার্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
এ সব দেখেই সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘এতে তো পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। একের পর এক ঘটনায় যে ভাবে পুলিশের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তাতে পুলিশকর্মীরা কাজ করবেন কী ভাবে! রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে।’’
এমনটা নয় যে, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছে! কারণ, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে ২০০৮-এ দক্ষিণ কলকাতার চারু মার্কেট থানায় চড়াও হয়েছিলেন তৃণমূলকর্মীরা। আবার ২০০৯-এ পুলিশি হাজতে থাকা এক বন্দির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলিপুর থানাতেই হামলা চালিয়েছিল তৃণমূল। ক্ষমতায় আসার পর নানা কারণে প্রায় রোজই রাজ্যের কোথাও না কোথাও পুলিশের উপরে চড়াও হয়েছেন শাসক দলের কর্মীরা। বিরোধীদের একাংশ জানাচ্ছেন, যে ভাবে পুলিশকর্মীকে সর্বসমক্ষে ‘চাবকানো উচিত’ বলে ধমক দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী, সেখানে তাঁর পারিষদেরা এমনটা ঘটাবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪: শিলিগুড়ির ভক্তিনগরের নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনা দুই তৃণমূলকর্মীকে ছিনিয়ে গেল দলীয় নেতৃত্ব। পুলিশকর্মীদের মারধর। গাড়ি ভাঙচুর।
সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, তৃণমূল পুলিশকে তাদের দলের একটা শাখা সংগঠন হিসেবেই দেখে। তাঁর কথায়, ‘‘দলের মধ্যে কারও সঙ্গে বনিবনা না হলে ওরা যেমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে একে অপরকে আক্রমণ করে, পুলিশ কর্মীদেরও সেই ভাবেই দেখে। আর পুলিশও এই আক্রমণ নিজেরা আমন্ত্রণ করে নিয়েছে। আইনের শাসন না মেনে দলীয় আনুগত্য মেনে নিলে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক!’’
একই সুর শোনা গেল বিজেপি নেতা তথা দলীয় বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের গলায়। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ কার্যত তৃণমূলের একটি সেবা দলে পরিণত হয়েছে। শাখা সংগঠন ভুল করলে মূল সংগঠন তাদের শাসন করে ভুল শুধরে দেবে এটাই তো তৃণমূলে দস্তুর। শিলিগুড়িতে ঠিক তাই হয়েছে। কারণ এটাই তৃণমূল কংগ্রেস।’’