গা-জোয়ারির জয়জয়কার

সাফল্যে ঢাকা পড়ল না ভোট লুঠের কলঙ্ক

ব্যবধান ৬ মাসের। কলকাতা পুরসভার ভোটের ছবিরই পুনরাবৃত্তি হল আড়াইখানা পুর-নিগমের নির্বাচনে! প্রত্যাশিত ভাবেই বিধাননগর, আসানসোল ও বালির পুরভোটে বিপুল জয় পেল শাসক দল। কিন্তু ভোটের দিনের তাণ্ডব এবং ভোট-লুঠের ঘটনার জেরে সেই জয়ের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন থেকে গেল।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫৯
Share:

জয়ের উল্লাস। সল্টলেকের একটি গণনাকেন্দ্রের বাইরে তৃণমূল সমর্থক। শনিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

ব্যবধান ৬ মাসের। কলকাতা পুরসভার ভোটের ছবিরই পুনরাবৃত্তি হল আড়াইখানা পুর-নিগমের নির্বাচনে!

Advertisement

প্রত্যাশিত ভাবেই বিধাননগর, আসানসোল ও বালির পুরভোটে বিপুল জয় পেল শাসক দল। কিন্তু ভোটের দিনের তাণ্ডব এবং ভোট-লুঠের ঘটনার জেরে সেই জয়ের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন থেকে গেল। যে সব পুর-এলাকায় এ বার ভোট হয়েছে, তার মধ্যে পুরনো বিধাননগর ও আসানসোল পুরসভা তৃণমূলেরই হাতে ছিল। যদিও গত লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে দুই শহরেই তারা পিছিয়ে পড়েছিল বিজেপির কাছে। গেরুয়া হাওয়া শুষে নিয়ে দু’জায়গাতেই এ বার ঘাসফুলের আধিপত্য। আর বালি পুর-এলাকা দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে সিপিএমের হাত থেকে দখল নিল তৃণমূল। কিন্তু এ সব সাফল্যেই লেগে থাকল কালির দাগ! প্রশ্ন রয়ে গেল, সন্ত্রাস আর ভোট-লুঠ ছাড়া এমন জয় সম্ভব ছিল কি? নাগরিক সমাজের কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলে দিলেন, ‘‘বিধাননগরে ৩৭ কেন? ওখানে যা হয়েছে, তাতে তো ৪১-এর মধ্যে শাসক দলের ৪২ বা ৪৩ পাওয়া উচিত ছিল!’’ ঠিক যে প্রশ্ন উঠেছিল গত এপ্রিলে কলকাতার পুরভোটে ব্যাপক মারদাঙ্গার পরে শাসক দলের একতরফা জয় নিয়ে!

বস্তুত, গত লোকসভা ভোট, তার পরে রাজ্যে বেশ কিছু উপনির্বাচন এবং ৬ মাস আগে কলকাতা-সহ ৯১টি পুরসভার ফলের নিরিখে দেখলে তৃণমূলের সাফল্য এখনও ধারাবাহিক। এ বারও বিধাননগর বা বালিতে ধারে-ভারে তারাই ছিল এগিয়ে। কিন্তু যা হতে পারত স্বাভাবিক জয়, পেশিশক্তির দাপট দেখাতে গিয়ে তাকেই কলঙ্কিত করে ফেলার ধারাবাহিকতা ধরে রাখল তৃণমূল! সেই সঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে জনতার মনোভাব যাচাই করার শেষ বড় সুযোগও হাতছাড়া হল। দলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য শনিবার মন্তব্য করেছেন, ‘‘এটা নিছক জয় নয়। এটা ইতিহাস! নিঃশব্দ বিপ্লব হল!’’ যা শুনে দলেরই এক নেতার সরস মন্তব্য, ‘‘সুব্রতদার কথাটা রূপক অর্থে ধরতে হবে। সত্যিই ইতিহাস। এই ইতিহাস রচনা করতে গিয়েই বহু জায়গায় সিপিএম আজ ইতিহাস!’’

Advertisement

ঘটনাচক্রে, বিধাননগর ও রাজারহাটে তৃণমূলের বিজয়োল্লাস দেখতে দেখতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব আরও এক বার মেনে নিয়েছেন, ‘‘ক্ষমতায় থাকার সময়ে ১৬ থেকে ১৭টা বিধানসভা কেন্দ্রে আমরা যে ভাবে ভোট করিয়েছি, সেটা ঠিক করিনি। আমি হয়তো দমদমে করেছি, কেউ হয়তো ভাঙড়ে করেছে, কেউ হয়তো ক্যানিংয়ে করেছে। ক্ষমতায় এলে আর কখনও এই প্রক্রিয়ায় ভোট করব না। উই উইল নেভার ডু ইট!’’ সেই সঙ্গেই গৌতমবাবুর প্রশ্ন, ‘‘সরকারে থেকে আমরা হয়তো পাঁচটা খারাপ কাজ করেছি। তৃণমূল শুধু সেগুলোই করতে পারে, আর আমাদের একশোটা ভাল কাজ করতে পারে না?’’ একই সুরে তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান সাংসদ একান্তে বলছেন, ‘‘আগামী দিনে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে! বালিতে ‘১৬-য় ১৬’ তো সিপিএমও পারেনি!’’ ওই নেতার উপলব্ধি, সিপিএমে যারা এমন ভোট করাত, তারাই সাদরে শাসক দলে স্থান পেয়েছে! ফল তো ভুগতে হবেই।

সে অবশ্য ভবিষ্যতের কথা। আপাতত এই ভোটকে বিরোধী নেতারা সমস্বরে প্রহসনই বলছেন। বিমান বসু, বাবুল সুপ্রিয় বা অধীর চৌধুরীরা বোঝাতে চেয়েছেন, এই ভোট থেকে বিধানসভা ভোটের আগে কোনও দলেরই শক্তির সঠিক আন্দাজ সম্ভব নয়। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন দাবি করেছেন, ‘‘বামফ্রন্ট নয়, নৈতিক পরাজয় হয়েছে তৃণমূলের। ভোট লুঠ করে তাদের জিততে হয়েছে।’’ ভোটের হিসেবও এই অভিযোগে ইন্ধন জোগাচ্ছে! ওয়ার্ডের নিরিখে বালি পুরোপুরি এবং বিধাননগর পুর-নিগমের সল্টলেক অংশ বিরোধীশূন্য। বালি ১৬-০ এবং সল্টলেক ১৪-০ জিতেছে তৃণমূল! বিধাননগর পুর-নিগমের মধ্যে রাজারহাট ও কৈখালি এলাকায় সিপিএম এবং কংগ্রেস দু’টি করে ওয়ার্ড জিতেছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় বিরোধীদের এই জয় বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের পক্ষে চিন্তার ঠিকই। কিন্তু শাসক দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের প্রভাব যে ওই ওয়ার্ডগুলিতে পড়েছে, তা মানছেন নেতারা। আসানসোলের ফল বরং ততটা ‘একতরফা’ নয়! সেখানে ১০৬টির মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ৭৪টি ওয়ার্ডে। বামেরা ১৭, বিজেপি ৮, কংগ্রেস তিন এবং নির্দল প্রার্থীরা চারটি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন।

এই সংক্রান্ত আরও খবর:

রাজশক্তিকে রুখে দেবরাজের জয়

বামেদের পতন, বালিতে নিরঙ্কুশ তৃণমূল

৪১-এ ৩৭, তবু রইল খচখচানি

আসানসোল: দেড় বছরে এক থেকে তিনে নেমে এল বিজেপি

বিধাননগরে ৪১ ওয়ার্ডে পুনর্নির্বাচনে মাত্র ১২ শতাংশ ভোট তৃণমূলের

দল বিধাননগর (৪১/৪১) বালি (১৬/১৬) আসানসোল (১০৬/১০৬)

৩৭ ১৬ ৭৪

২ ০ ১৭

২ ০ ৩

০ ০ ৮

০ ০ ৪

তৃণমূলের ‘নিরঙ্কুশ সাফল্য’ আরও বেশি স্পষ্ট ভোটপ্রাপ্তির হারে! বালিতে তৃণমূল পেয়েছে ৭৬% ভোট! সিপিএমের কণিকা গঙ্গোপাধ্যায়দের হাত ধরে ‘ভোট করিয়ে নেওয়া’ আগেও দেখেছে বালি। কংগ্রেস জমানার ’৭২ সালও প্রবীণদের মনে আছে। কিন্তু আগে কখনওই কোনও দল ৭৬% ভোট পায়নি! গত লোকসভার তুলনায় এ বার তৃণমূলের ভোট বেড়েছে প্রায় ৩৮%!

বিধাননগরে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৬২.৭%। গত লোকসভা ভোটে বিধাননগর ও রাজারহাটের দু’টি বিধানসভা এলাকার গড় ভোটের সঙ্গে ফারাক ধরলে তৃণমূলের ভোট এখানে বেড়েছে ২৫%-এরও বেশি! আর আসানসোলে লোকসভার তুলনায় শাসক দল ভোট বাড়িয়েছে ১৭.২%। যদিও সেখানে সব বিরোধী ভোট যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫৪%, যা তৃণমূলের চেয়ে প্রায় ৭% বেশি। অর্থাৎ বিরোধী ভোট ভাগের সুযোগ আসানসোলে পেয়েছে তৃণমূল।

বিধাননগর পুর-নিগমের মধ্যে সল্টলেক এলাকায় তৃণমূল প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান তা-ও ধরাছোঁয়ার মধ্যে। বিরোধীদের প্রশ্ন, ব্যবধান খুব বেশি হবে না বুঝেই কি বহিরাগত আনতে হয়েছিল? সব্যসাচী দত্ত, অনিতা মণ্ডল, কৃষ্ণা চক্রবর্তীরা তিন হাজারের কিছু বেশি ভোটে, দেবাশিস জানা, নীলাঞ্জনা মান্নারা দু’হাজারের কম-বেশি ভোটে জিতেছেন। সব চেয়ে ‘সংঘর্ষপূর্ণ’ ওয়ার্ড ৪১ নম্বরে তৃণমূলের অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলেরই বিক্ষুব্ধ নেতা তথা নির্দল অনুপম দত্তকে হারিয়েছেন ৯৮১ ভোটে। কিন্তু রাজারহাটের দিকে ঢুকলে ডাম্পি মণ্ডল সাড়ে ৮ হাজার, তাপস চট্টোপাধ্যায় ৭ হাজার, স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার, সিন্ডিকেট-পাণ্ডা বলে পরিচিত ভজাই সর্দারের ছেলে প্রসেনজিৎ পাঁচ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন! তিন নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে তৃণমূল প্রার্থী তাপসবাবু যেখানে ৮৩৭ ভোট পেয়েছেন, সেখানে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন যথাক্রমে ২, ১ ও ৬টি ভোট! বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অসীম দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এটা মানুষের রায়ের প্রতিফলন নয়। ভোট লুণ্ঠনের প্রতিফলন! সুযোগ পেলেই মানুষ এর জবাব দেবেন!’’

পাল্টা কটাক্ষে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘মানুষ যদি চায়, তা হলে এমনই ভোট হয়। বাতিল লোকেদের এনে এমন চেষ্টা হলে পুরনো ৩৪ বছরের কথা মানুষের মনে পড়ে যায়!’’ উন্নয়নের জোয়ারই বালি বা বিধাননগরে শাসক দলের ভোটপ্রাপ্তির হার বহু শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে পার্থবাবুর দাবি।

যদিও শাসক দলের অন্দরেই তখন গুঞ্জন— বাম আমলে কেশপুরে নন্দরানি ডল বা আরামবাগে অনিল বসুরা এ ভাবেই জয়ের হাসি হাসতেন। তৃণমূল আমলে সেই ধারাই কিছু ‘পকেট’ ছাড়িয়ে কলকাতা থেকে বালি বা বিধাননগর, সর্বত্র আরও প্রসারিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন