দুর্গাপুরে তৃণমূল কর্মীদের উল্লাস। —নিজস্ব চিত্র।
এ বারের নির্বাচনে পুরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডেই প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে তৃণমূলকে টেক্কা দিয়েছিল জোট। অথচ তেমনই একটি ‘হারা’ ওয়ার্ডে শুক্রবার ধুমধাম করে বেরলো শাসকদলের বিজয় মিছিল। তৃণমূল সূত্রে খবর, সম্প্রতি দুর্গাপুরের দু’টি কেন্দ্রের ফল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি কমিটি। শাসকদলের অন্দরেই গুঞ্জন, তা হলে কি কমিটির নজর ঘোরাতেই দুর্গাপুরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে এই মিছিলের আয়োজন!
শহরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডটিতে দুর্গাপুর পশ্চিমের তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব মুখোপাধ্যায় জোট প্রার্থীর তুলনায় ৩৮৭ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। এখানে খারাপ ফলের কারণ হিসেবে অনেকেই তৃণমূল কাউন্সিলর অরবিন্দ নন্দীর দিকে আঙুল তুলেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭-এর পুরভোটে সিপিএমের হাত থেকে ওয়ার্ডটি ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। কংগ্রেসের সেই জয়ে অরবিন্দবাবু বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে খবর। পরে অবশ্য দলবদলে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১২-র পুরভোটে তদ্বির করেও প্রার্থী অরবিন্দবাবুকে প্রার্থী করেনি তৃণমূল। সে বার অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ‘নির্দল’ হিসেবে দাঁড়িয়ে তিনি ৭৯ ভোটে হারিয়ে দেন সিপিএম প্রার্থীকে। ওই ভোটে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল মোটে ৩১৯টি ভোট পায়। কাউন্সিলর হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই অবশ্য ফের তৃণমূল যোগ দেন অরবিন্দবাবু।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে নাম জড়ায় অরবিন্দবাবুর। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য সরকারি সংস্থা ‘দুর্গাপুর কেমিক্যালস লিমিটেড’-র শ্রমিক সংগঠনের দখলকে কেন্দ্র তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় অরবিন্দবাবুর ভূমিকা ছিল বলে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের দাবি। ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুকের একটি ইস্পাত কারখানায় বোনাস বাড়ানোর দাবিতে ঢুকে কর্মী-আধিকারিকদের মারধর, ভাঙচুরের ঘটনাতেও নাম জড়ায় এই কাউন্সিলরের। শুধু তাই নয়, কয়েক জন প্রভাবশালীকে তুষ্ট করতে দামোদরের পাড়ে হুজুগডাঙায় রিসর্ট বানানোতেও উদ্যোগ নিতে দেখা যায় তাঁকে। তৃণমূলের অন্দরেই কর্মীদের একাংশের দাবি, একের পর এক এমন ঘটনায় নাম জড়ানোয় আখেরে দলেরই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে দুর্গাপুরের ৪৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪০টিতেই পিছিয়ে তৃণমূল। ১১ থেকে ২২ ও ২৯ থেকে ৪৩ নম্বর— মোট ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র। পুরোটাই শহর এলাকা। গত বিধানসভায় এই কেন্দ্র বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। সে বার তৃণমূল-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট। সিপিএম ও বিজেপি পায় যথাক্রমে ৪২, ৩ শতাংশ ভোট। পরের বছর দুর্গাপুর পুরসভাও বামেদের থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে এখানে তারা পায় ৬৩ হাজার ৮১৮। দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। তারা পায় ৫৫ হাজার ৫৩১টি ভোট। সিপিএমের ঝুলিতে আসে ৫৫ হাজার ৪৩৪টি ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিল হাজার আটেকের সামান্য বেশি ভোট। এ বার ভোটে দল ফের প্রার্থী করে বিদায়ী বিধায়ক মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায়কে। গত বিধানসভার তুলনায় ২০১২-র পুরভোটে ৯টি ওয়ার্ডে ভোট বেড়েছিল তৃণমূলের। কিন্তু ভোট কমে যায় ১৮টি ওয়ার্ডে। আবার পুরভোটের তুলনায় ২০১৪-র লোকসভা ভোটে একটি ওয়ার্ড বাদে সব ক’টিতেই ১০-২০ শতাংশ করে ভোট কমে তৃণমূলের।
২০১৬-র ভোটেও শহরের এই ওয়ার্ডগুলিতে শাসকদলের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। ফলপ্রকাশের পর দেখা যায় দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের ২৫টি ওয়ার্ডেই তৃণমূল পিছিয়ে। শুধুমাত্র ৩১ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে নামমাত্র ভোটে এগিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। ভোটে কুপকাত হতেই কালীঘাটের বৈঠকে এই কেন্দ্রের ফল নিয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়ার সুপারিশ করা হয়। ইতিমধ্যেই দুর্গাপুরে সেই কমিটি তৈরিও হয়ে গিয়েছে বলে খবর। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে রিপোর্ট জমা পড়বে সেই কমিটির কাছে। কমিটি তা পর্যালোচনা করে জেলা নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজ্যে পাঠাবে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। নির্বাচনে কোনও নেতা-কর্মীর ভূমিকা সন্দেহজনক ঠেকলেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তাদের নামে শাস্তির সুপারিশ করবে কমিটি। যাঁদের জন্য দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধেও শাস্তির সুপারিশ করা হবে বলে জানা গিয়েছে। তৃণমূল সূত্রে খবর, এই কমিটি গঠনের পরেই চাপে পড়ে গিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী। তৃণমূলের একাংশের দাবি, অরবিন্দবাবুর মতো অনেকেই সেই সন্দেহভাজনদের তালিকার বাইরে নন।
তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর মতে দলের আস্থাভাজন হয়ে উঠতেই এমন বিজয় মিছিলের আয়োজন। তৃণমূলের এক কর্মীর প্রশ্ন, ‘‘যে ওয়ার্ডে দল পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে এই ঢাক, তাসা নিয়ে বিজয় মিছিলের যৌক্তিকতা কোথায়?’’ অরবিন্দবাবুর যদিও দাবি, ‘‘আমি নই। শপথ গ্রহণ উপলক্ষে দলের ছেলেরা মিছিলের আয়োজন করে।’’ দলের দুর্গাপুর জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি উত্তম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘দলের তরফে কোথাও কাওকে বিজয় মিছিল করতে বলা হয়নি। কে বা কারা করেছেন আমি জানি না। তদন্ত কমিটি তার কাজ করছে।’’