যত দূরেই যাও, বাড়তি ভাড়া এক টাকা! কিন্তু যত গোল যে ওই এক টাকাতেই।
সরকারের কাছ থেকে বাসের ভাড়া এক টাকা বাড়ানোর সবুজ সঙ্কেত আদায় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। মাসখানেক আগে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সর্বস্তরে বাসের ভাড়া এক টাকা করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে রাজ্যের পরিবহণ দফতর। কিন্তু পাঁচ কিলোমিটার গেলে বাড়তি ভাড়া এক টাকা আর ৫০ কিলোমিটার গেলেও এক টাকা! এটা যে হতে পারে না, এত দিনে সেটা সরকারের মগজে ঢুকেছে। চাপে পড়ে জেলার বাস ও দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বাসের ভাড়া আরও খানিকটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। এবং সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল একেবারেই চুপিসারে।
গত দু’বছরে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাসভাড়া বাড়াতে রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নিয়ে সরকারের সঙ্গে বাস-মালিকদের আলোচনা, টানাপড়েন চলছিলই। সরকারের অনড় মনোভাবের জন্য অনেক মালিকই রাস্তা থেকে বাস তুলে নিতে বাধ্য হন। শুধু বেসরকারি নয়, বসে যায় অনেক সরকারি বাসও।
সঙ্কট চরমে পৌঁছনোয় পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর চেষ্টায় গত ২৫ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় বাস-মালিকদের। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, সরকার কোনও অবস্থাতেই বাসের ভাড়া এক টাকার বেশি বাড়াবে না। অর্থাৎ ভাড়া ১০ টাকা হলে সেটা হবে ১১ টাকা। ব্যস! জেলার এক বাস-মালিকের কথায়, “আমাদের বাসের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভাড়া ছ’টাকা। সেটা এক টাকা বেড়েছে। আবার দূরপাল্লার কোনও রুটে ১০০ টাকা ভাড়া থাকলে সেটা বেড়ে হয়েছে ১০১ টাকা!”
সরকারের ঘোষণায় বাস-মালিকেরা খুশি না-হলেও কলকাতা ও শহরতলির বাস-মিনিবাসের ক্ষেত্রে এই নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় দূরপাল্লা এবং জেলার বাসের ক্ষেত্রে। কারণ, দূরপাল্লা ও জেলার বাসের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভাড়ার পাশাপাশি তার পরের প্রতি কিলোমিটারে বৃদ্ধির হারও নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এক টাকার বেশি ভাড়া বাড়ানোর বিপক্ষে রায় দেওয়ায় কিলোমিটার-পিছু ভাড়ার হারে পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ যাত্রী যে-দূরত্বেই যান না কেন, আগের ভাড়ার থেকে বাড়তি হিসেবে মাত্র এক টাকাই দেবেন তিনি। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকম: শিলিগুড়ির বাসে উঠে কৃষ্ণনগর যেতে এক জন যাত্রী আগের ভাড়ার চেয়ে এক টাকা বেশি দেবেন। আবার যাঁর গন্তব্য শিলিগুড়ি, তিনিও বাড়তি হিসেবে দেবেন ওই এক টাকাই। স্বভাবতই ভাড়া বৃদ্ধির এই যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাস-মালিকেরা।
বিষয়টি নজরে আসরে পরিবহণ কর্তাদেরও। তাঁরা বুঝতে পারেন, হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছে বিলকুল। তাই জেলা ও দূরপাল্লার জন্য নতুন ভাড়ার হার ঠিক করা হয়েছে। ঠিক হয়েছেস কিলোমিটার-পিছু ১০ পয়সা হারে ভাড়া বাড়বে। অর্থাৎ যেখানে ভাড়া ১০০ টাকা, তা বেড়ে হবে ১১০। বাস-মালিক সংগঠন সূত্রের খবর, শুক্রবার রাজ্য জুড়ে পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বিরোধী কর্মী ইউনিয়নগুলি। জেলার বাস-মালিকেরা ঠিক করেছিলেন, ধর্মঘট সফল করতে তাঁরা পরোক্ষে সমর্থন জানাবেন। মুকুলবাবুকে এ কথা জানান তাঁরা। তিনি বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে জেলা এবং দূরের এক্সপ্রেস বাসে কিলোমিটার-পিছু ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে সম্মতি দেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাসভাড়ার পরিমার্জিত হার নিয়ে পরিবহণ দফতরের কর্তারা মুখ খুলতে নারাজ। তবে জেলার বাস-মালিকদের কাছে ভাড়া বৃদ্ধির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। এক কর্তার কথায়, “এর পরে বাস-মালিকেরা নিশ্চয়ই ধর্মঘট সমর্থন করবেন না।” কিন্তু ঘটনা হল, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তেও বাস-মালিকদের একাংশ পুরোপুরি খুশি নন। তাঁরা বলছেন, “বাস চালিয়ে ব্যাঙ্কঋণ শোধ করা যাচ্ছিল না। সেটা হয়তো এ বার করা যাবে। কিন্তু এই বৃদ্ধিতে আয় বাড়বে না।”
ভাড়া নিয়ে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে বাস-মালিক সংগঠনগুলিও দ্বিধাবিভক্ত। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটসের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের নতুন ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “সরকারের একটা ভুল হয়েছিল। সেটা সংশোধিত হওয়ায় অনেক সমস্যারই সমাধান হবে।” অন্য সুর বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকারের গলায়। তিনি বলছেন, “বাসভাড়া নিয়ে সরকার ছেলেখেলা শুরু করেছে! কখনওই ঠিকঠাক হারে ভাড়া বাড়াচ্ছে না সরকার। প্রথমে নামমাত্র বাড়ানো হয়েছিল। তার পরে যা-ও বা বাড়ল, তাতে আমাদের কোনও উপকার হবে না।” ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের গড়ে দেওয়া কমিটির প্রস্তাবও মানা হয়নি বলে অভিযোগ দীপকবাবুর।