নিউটাউনে সরকারি কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
এ বার সরকারি মঞ্চ থেকেও বাঙালি নিপীড়নের অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকারকে তোপ দাগলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার মধ্য কলকাতার ডোরিনা ক্রসিংয়ে তৃণমূলের মঞ্চ থেকে কেন্দ্রকে নিশানা করেছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার একই অভিযোগে কেন্দ্রকে আক্রমণ শানালেন নিউ টাউনের সরকারি কর্মসূচি থেকে। মমতার অভিযোগ, কেউ বাংলায় কথা বললেই তাঁকে ‘ডিপোর্ট’ (দেশ থেকে তাড়ানো) করার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
নিউ টাউনের ওই সরকারি অনুষ্ঠান থেকে বৃহস্পতিবার পাঁচটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই বক্তৃতার সময় সব ভাষার প্রতি তাঁর সম্মানের কথা তুলে ধরেন মমতা। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “একটা নোটিফিকেশন (বিজ্ঞপ্তি) করে বলছে, বাংলা ভাষায় কথা বললেই তাঁদের ডিপোর্ট করে দাও। কেন? ওরা জানে না, বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা সারা এশিয়ায় দ্বিতীয়। আর সারা পৃথিবীতে পঞ্চম।” মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন, ভারতের যে কোনও নাগরিক দেশের যে কোনও জায়গায় যেতে পারেন। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে বাংলায় কথা বললেই যে ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে কথাও বক্তৃতায় তুলে ধরেন মমতা।
শুধু ‘বাংলাদেশি’ বলেই নয়, ভিন্রাজ্যে বাংলাভাষীদের ‘রোহিঙ্গা’ বলেও দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। রোহিঙ্গারা যে আসলে মায়ানমারের একটি জনজাতি, তা-ও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। মমতা বলেন, “যাঁকেই পাচ্ছে বাংলা ভাষায় কথা বললেই বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গা। কোথা থেকে এল রোহিঙ্গা? রোহিঙ্গা তো মায়ানমার। ওরা বাংলা জানল কোথা থেকে? যাঁরা বলছেন তাঁরা এক বার বুঝবেন না!” মমতা আরও বলেন, “কেউ বলছে ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে। আমি বলছি, ঠিকানা দিন। বলুন কোথায় তাঁরা আছেন।”
মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী-মুজিবুর রহমানের চুক্তির সময়েই বাংলাদেশি উদ্বাস্তুরা এ দেশে এসেছিলেন। ওই সময় যে উদ্বাস্তুরা ভারতে এসেছিলেন, তাঁরা যে ভারতীয় নাগরিক, সে কথাও স্পষ্ট করে দেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অনেকের দেশভাগের আগে বা ১৯৭১ সালে এ দেশের চলে আসার আগে জন্ম হয়েছে। তাঁদের কথ্য ভাষার মধ্যে স্থানীয় টান রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন, তাঁরা বাংলাদেশি নন। ভীষণ ভাবে ভারতীয়। পশ্চিমবঙ্গেও যে এক এক জেলায় কথ্য ভাষায় নিজস্ব টান রয়েছে তা-ও মনে করিয়ে দেন তিনি।
বস্তুত, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাময়িক ভাবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। নাম না-করে সে দিকেও ইঙ্গিত করেন মমতা। তিনি বলেন, “আমাদের অতিথি তো কয়েক জনকে রেখেছে ভারত সরকার। আমি কি না করেছি? কারণ, রাজনৈতিক কারণ আছে, ভারত সরকারের অন্য কারণ আছে। পাশের দেশ বিপদে পড়েছে। কই, আমরা তো কখনও বলি না। তা হলে আপনারা কেন বলবেন, বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি হয়ে গেল!” কেন্দ্রকে বিঁধে মমতা বলেন, “আজ সকলের উপর অত্যাচার হচ্ছে। কেন বলবে ১৭ লক্ষ লোকের নাম বাদ দিয়ে দাও! কে তুমি হরিদাস? কে তোমরা? যে ভারতীয় নাগরিক সে-ই ভোট দেবে। যাঁরা বাংলায় বাস করেন, বাংলার নাগরিক, কেন তুমি তাঁর নাম কাটবে? সে কোন জাত, কোন ধর্ম তা তোমার দেখার দরকার নেই। তাঁরা ভীষণ ভাবে বাংলার ভোটার।”
মমতা জানান, তিনি বাংলার মানুষের জন্য গর্বিত। তিনি যে হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, গুজরাতি, মরাঠি, পঞ্জাবি, অসমিয়া, ওড়িয়ার মতো বিভিন্ন ভাষা বুঝতে পারেন, তা-ও বক্তৃতায় জানান মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র, অসম এবং ওড়িশায় বাংলাভাষীদের হেনস্থার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূলশিবির। বৃহস্পতিবার মমতা যখন জানান তিনি ওড়িয়া ভাষাও বোঝেন, তখন তিনি এ-ও বলেন, “খাউন্তি, করুন্তি, যাউন্তি, কিন্তু ঝগড়া না করুন্তি। আমাদের লোকেদের উপর অত্যাচার না করুন্তি।” বাংলার যে শ্রমিকেরা ভিন্রাজ্যে কাজ করতে যান, তাঁরা যে যথেষ্ট দক্ষ তা-ও স্মরণ করিয়ে দেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার শ্রমিকেরা দক্ষ বলেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ভিন্রাজ্যে।’’ মমতা বলেন, “রাজনীতি করতে গেলে আগে মনকে ঠিক করতে হবে। মনে রাখবেন রাজনৈতিক লোকেরাই সরকার চালায়। যদি তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে সঠিক না হন, তাঁরা ভাল প্রশাসক হতে পারেন না। সরকার চালাতে গেলে মাথা চালাতে হবে। মগজে মরুভূমি হলে হবে না, মগজটাকে খুলে দিতে হবে খোলা হওয়ায়, মুক্ত আকাশে, মুক্ত বাতাসে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে হবে।”
উঠল কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা
বৃহস্পতিবার নিউ টাউনের কর্মসূচি থেকে বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগেও ফের সরব হন মমতা। কেন্দ্র টাকা বন্ধ রাখার পরেও রাজ্য নিজ উদ্যোগে যে ‘বাংলার বাড়ি’র টাকা দিচ্ছে, তা-ও স্মরণ করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জানান, পর পর পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গ একশো দিনের কাজে, গ্রামীণ আবাস যোজনায় এবং গ্রামীণ রাস্তা কর্মসূচিতে ভারতে এক নম্বর স্থানে ছিল। এর পরেই তিনি বলেন, “কিন্তু গত চার পাঁচ বছর ধরে আমাদের টাকা বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্র। এক পয়সাও দেয় না। এখন তো সব বন্ধ। আমাদের পাওনা টাকা আমরা পাচ্ছি না। তা সত্ত্বেও আমাদের রাজ্যের টাকায় সরকারি কোষাগার থেকে ১২ লক্ষ বাংলার বাড়ির টাকা ইতিমধ্যে আমরা দিয়ে দিয়েছি। আরও ১৬ লক্ষ মানুষ ডিসেম্বর মাসে একটি কিস্তি পেয়ে যাবেন। আরেকটি কিস্তি মে মাসে (আগামী বছর) পাবেন।” অর্থাৎ, সব মিলিয়ে যে ২৮ লক্ষ মানুষ ‘বাংলার বাড়ি’র সুবিধা পাবেন, তা মনে করিয়ে দেন মমতা। প্রকল্পের বাকিটুকুও ধাপে ধাপে করে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
গরিবদের জন্য স্বল্পমূল্যে ফ্ল্যাট
নিউ টাউনের কর্মসূচি থেকে রাজ্যের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্বল্পমূল্যের আবাসন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রকল্প দু’টির নাম— ‘নিজন্ন’ এবং ‘সুজন্ন’। সাত একর এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে এই বহুতল আবাসনগুলি। ‘নিজন্ন’ প্রকল্পে রয়েছে ৩০০ বর্গফুটের ৪৯০টি এক কামরার ফ্ল্যাট। এগুলি ১৫ তলের আবাসন। এগুলি তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলদের জন্য। ‘সুজন্ন’-তে রয়েছে ৬২০ বর্গফুটের দুই কামরার ৭২০টি ফ্ল্যাট। এগুলি ১৬ তলের আবাসন। এগুলি তৈরি হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। মুখ্যমন্ত্রী জানান, “মোট সাত একর জমিতে ২৯০ কোটি টাকা খরচ করে এগুলি তৈরি হয়েছে। এখানে ১২১০টি ফ্ল্যাট (নিজন্ন এবং সুজন্ন মিলিয়ে) রয়েছে। অনেক মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারবে। জমি সরকার দিয়েছে। জমির দাম নেওয়া হয়নি। এ ছাড়াও ভর্তুকি দিয়ে বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে এই ফ্ল্যাটগুলি আপনারা পাবেন। লটারি করে স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে বিলি হবে। এই আবাসন করার জন্য সাত একর জমি বিনামূল্যে রাজ্য সরকার দিয়েছে।” রাজারহাটে সাত একর জমির দাম যে অনেক বেশি, তা-ও মনে করিয়ে দেন মমতা। তিনি বলেন, “আমরা চাই প্রত্যেক মানুষের একটা নিজস্ব ছাদ থাকুক। মানে নিজস্ব অঙ্গন, নিজস্ব আশ্রয় থাকুক।”
এ ছাড়া নিউ টাউনে বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টার এবং ‘রূপান্ন’র পাশে একটি নবনির্মিত বহুতল পার্কিং কমপ্লেক্স ‘সুসম্পন্ন’রও উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। আটতলবিশিষ্ট এই অত্যাধুনিক পার্কিং কমপ্লেক্সে রয়েছে ১৫১২টি গাড়ি রাখার জায়গা। ‘তরণ্য’ নামে একটি মুক্তমঞ্চ এবং শিশুদের জন্য বিনোদন পার্কেরও উদ্বোধন হয় বৃহস্পতিবার। এখানে আছে দ্বিতলবিশিষ্ট ক্যাফেটেরিয়া এবং ২০০ আসনবিশিষ্ট মুক্তমঞ্চ। জলপাইগুড়ি জেলায় ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশ মন্দির যাওয়ার পথে নদীর উপর একটি নবনির্মিত সেতু, জল্পেশ মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে জল্পেশ মন্দিরের শিবচতুর্দশী দ্বার পর্যন্ত যাওয়ার নতুন সেতু এবং উভয় দিকের রাস্তারও উদ্বোধন মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে। এই পাঁচটি বড় প্রকল্পে প্রায় ৪৫৫ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান মমতা।