—ফাইল চিত্র।
চিংড়ি তো নয়, যেন উসেইন বোল্ট! এমনই গতি তার।
দৌড়ে নয়, উৎপাদন বৃদ্ধিতে। এ রাজ্যেরই একটি জেলায় ৩০০ টন দিয়ে উৎপাদন শুরু হয়েছিল। মাত্র চার বছর পরে সেই জেলাতেই তার উৎপাদন ৪০ হাজার টন। সেই চিংড়ি বিদেশে রফতানি করে মিলেছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা! রাজ্য সরকারের আশা, চিংড়ির এই নতুন অতিথির হাত ধরেই বদলে দেওয়া যাবে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা।
নাম তার ভ্যানামেই। আদি নিবাস উত্তর আমেরিকায়। জাত-বংশের বিচারে চিংড়ি সমাজে কুলীন নয় তেমন। গলদা, বাগদা তো বটেই, চাপড়া বা হরিণার তুলনাতেও সে পিছিয়ে। তাতে কী? ‘জন্ম হউক যথা তথা, কর্ম হউক ভালো।’ নিজের কাজেই খেল দেখাচ্ছে ভ্যানামেই।
কিছু কাল যাবৎ বাজারে এই নতুন ধরনের চিংড়ির দেখা মিলছে। সাদাটে দেখতে, তবে চাপড়া চিংড়ির মতো দুধসাদা নয়। একটু ঘোলাটে মতো। মাথায়-লেজে চাপড়ার মতো লাল ছোঁয়াও নেই। আবার হরিণার মতো রোগাটে চেহারাও নয়। বরং রীতিমতো পুরুষ্টু ও বলশালী। কোনও কোনও মাছবিক্রেতা আনাড়ি ক্রেতাকে ভ্যানামেই চিংড়িকেই চাপড়া বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। মাছের বাজারে ভ্যানামেই নামটা অবশ্য এখনও তেমন চালু হয়নি। কিন্তু মৎস্যজীবী ও রফতানিকারীদের আশা, যে গতিতে এগোচ্ছে ভ্যানামেই, তাতে চাপড়ার ভেক ধরে তাকে আর বেশি দিন থাকতে হবে না। স্বনামেই খ্যাত হবে সে বাজারে বাজারে।
এ রাজ্যে ভ্যানামেই-এর চাষ শুরু হয়েছিল চার বছর আগে, পূর্ব মেদিনীপুরে। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার নোনা জলে দ্রুত বাড়ছিল ভ্যানামেই। সম্প্রতি কম লবণাক্ত জলেও ভ্যানামেই চাষে পথ দেখিয়েছে হরিয়ানা। সেখানে দুই মৎস্যবিজ্ঞানীর পরামর্শে ভ্যানামেই চাষ করে প্রথম বছরে উৎপাদন পাওয়া গিয়েছে ১০ হাজার টন। সেখান থেকে গুজরাতের মাছ রফতানিকারক বিভিন্ন সংস্থা যেমন চিংড়ি কিনছে, দিল্লির বাজারেও ভ্যানামেই দেদার বিকোচ্ছে।
এক দিকে ভ্যানামেইয়ের মারমার-কাটকাট উৎপাদনের হার, অন্য দিকে তার লাভজনক বাজার দেখে উৎসাহ পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য দফতর। এখন তারা বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কম লবণাক্ত জলেও ওই চিংড়ির চাষ করতে উদ্যোগী হয়েছে। যে দুই বিজ্ঞানী হরিয়ানাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁরা মৎস্য দফতরের আমন্ত্রণে এই রাজ্যে এসে জানিয়ে গিয়েছেন, এখানকার অল্প লবণাক্ত জলেও ভ্যানামেইয়ের চাষ সম্ভব। বলেছেন, জল এক শতাংশ বা তার কম লবণাক্ত হলেও ওই চিংড়ি চাষ করা যাবে। ফলে উপকূলবর্তী নয়, এমন জেলাতেও রাজ্য সরকার ভ্যানামেইয়ের চাষে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।
রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘বর্ধমানের মেমারিতে মৎস্য উন্নয়ন নিগমের চৈতখণ্ড বলে একটি জলাশয় আছে। প্রথমে ওই জমিতেই পরীক্ষামূলক ভাবে ভ্যানামেই চিংড়ির চাষ করা হবে।’’ এই চিংড়ি চাষের খরচ বাগদা চাষের তুলনায় কম।
মৎস্য দফতর সূত্রের খবর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় এই চিংড়ি চাষে সাফল্য মিললে কাজের কাজ হবে। ওই সব জেলার অধিকাংশ জমিই একফসলি। বহু জায়গায় বৃষ্টির জলের অভাবে চাষও ভাল করে হয় না। মত্স্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ঠিক মতো ভ্যানামেই চাষ করতে পারলে এক হেক্টর জমিতে বছরে দশ টনের বেশি চিংড়ি উত্পাদন করা যায়। দফতরের কর্তাদের আশা, সাফল্য মিললে ভ্যানামেইয়ের উৎপাদন বাড়বে, জেলাগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থাও বদলে যাবে।
কী করে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভ্যানামেইয়ের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। চোখ বুজে খেতে হলে ভ্যানামেই বাগদার স্বাদের কাছাকাছি। তবে বাগদার মতো সুদর্শন নয়। বাগদার মতো মাথা, খোলা ও লেজ-সহ রান্না করাও মুশকিল। এর নিজস্ব জৈব গন্ধও তত চড়া নয়। কিন্তু চিলি প্রন, ফ্রায়েড প্রন, প্রন পকোড়ার মতো পদে যেখানে শুধু চিংড়ির শাঁসটাই লাগে, সেখানে বাগদার তুলনায় ভ্যানামেই অনেকটাই আয় দেবে। যে কারণে, অদূর ভবিষ্যতে রেস্তোরাঁ ও কেটারারদের কাছে ভ্যানামেই কদর পাবে বলে মৎস্য দফতরের আশা।
রাজ্যের সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রফতানিকারক সংস্থাগুলির সংগঠনের সভাপতি রাজর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার মতো জেলায় ওই চিংড়ির চাষ ঠিকঠাক হলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ি রফতানি আরও বাড়বে। চাষের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলিরও আর্থিক চেহারা বদলে যাবে।’’ কাজেই শুধু রসনা তৃপ্তি নয়, মৎস্যচাষিদের কাছেও ভরসার নতুন নাম হতে পারে ভ্যানামেই।