হবে জয়
Ambulance Driver

অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরাই খাওয়াচ্ছেন রোগীর স্বজনদের 

দু’সপ্তাহ পেরোতে চলল। রোজ দেড়শো থেকে একশো আশিটা পাত পড়ছে। এর মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডিম, মাছ, সয়াবিন হয়েছে।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২০ ০৩:১৮
Share:

শক্তিনগরে পারস্পরিক দূরত্ব বিধি মেনেই করা হয়েছে খাওয়ার ব্যবস্থা। নিজস্ব চিত্র

দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

Advertisement

একটু খাবারের খোঁজে হাসপাতাল গেটের বাইরে ঘোরাঘুরি করে কাহিল হয়ে গাছতলায় শুয়ে পড়েছেন ধুবুলিয়ার ভোলা সাহা। জামাইবাবুর ডায়ালিসিস হবে, তাই দু’দিন ধরে নদিয়ার শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে পড়ে আছেন। পাউরুটি আর কলা খেয়ে দিন কাটছে। কিন্তু সে আর কত খাওয়া যায়? সমস্ত হোটেল বন্ধ, দু’দিন পেটে ভাত পড়েনি।

দু’দিন ধরেই ভোলাকে হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে দেখছিলেন অ্যাম্বুল্যান্স চালক হারান শেখ। তাঁরও কাজ বিশেষ নেই। করোনার দৌলতে হাসপাতালে রোগী আসা কমে গিয়েছে। তাই তাঁদের বেশির ভাগ সময় বসেই কাটছে। ভোলাকে শুয়ে থাকতে দেখে হারান গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার। সবটা শুনে তাঁর মনে হয়, তাই তো, আরও কয়েক জন রোগীর বাড়ির লোককেও দেখেছেন খাবার খুঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে। পকেটে টাকা থাকলেও তাঁরা খাবার পাচ্ছেন না।

Advertisement

কিছু একটা করা দরকার! হারান কথাটা তোলেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রণব মালাকারের কাছে। হাসপাতালে প্রণবের নিত্য আনাগোনা। তিনিও হারানের কথায় সায় দেন— সত্যিই তো, লোকগুলো খাবে কী? দু’জনে কথাটা পাড়েন অ্যাম্বুল্যান্স চালক সুবীর মোদক, বাবু ঘোষ, হাবু সাহা, কাঞ্চন বাসপোদের কাছে। সকলেই একমত, রোগীর পরিজনের খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

আরও পড়ুন: লোক মেলেনি, নিজেরাই নিজেদের লালারস সংগ্রহ করে ট্রপিক্যালে গেলেন কোয়রান্টিনে থাকা পিজিটিরা

সদ্য লটারিতে ৯০ হাজার টাকা পেয়েছেন হাবু। তিনিই প্রথম পাঁচ হাজার টাকা দেন তহবিলে। প্রথম দিন, ৩ এপ্রিল, সেই টাকাতেই হাঁড়ি চড়ে। এলাকার এক ওষুধের দোকানের কর্মী অশোক সাহা খানিক রান্নাবাড়া জানেন। তাঁরই ঘাড়ে চাপে হেঁশেলের ভার। প্রায় দেড়শো জন লোকের পাতে পড়ে ডিম-ভাত। হারানেরা ঠিক করে ফেলেন, যত দিন লকডাউন চলবে, তত দিন তাঁরা রোগীর পরিজনের খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাঁদের দেখে আস্তে আস্তে অন্য অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরাও এগিয়ে আসেন।

দু’সপ্তাহ পেরোতে চলল। রোজ দেড়শো থেকে একশো আশিটা পাত পড়ছে। এর মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডিম, মাছ, সয়াবিন হয়েছে। এক দিন ছ’কেজি চালানি রুইয়ের দাম মিটিয়েছেন বছর পঞ্চাশের নিতাই দাস। তিনি হাসপাতালেই আয়ার কাজ করেন। আর এক দিন কেজি ছয়েক বাটা মাছ কিনে দিয়েছেন ঠিকাদার নিরাপত্তা সংস্থার রক্ষী মঙ্গল শীল। হাসপাতালের কয়েক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী মিলে এক বস্তা চাল কিনে দিয়েছেন। সাফাইকর্মীরাও যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ভয় কিসের? বেলগাছিয়া বস্তিতে করোনা-যুদ্ধে বলছেন ওঁরা

উদ্যোক্তারা জানান, নিজেই এগিয়ে এসে চার হাজার টাকা দিয়েছেন শল্য চিকিৎসক দিগন্ত মণ্ডলও। আর অন্য চিকিৎসকেরা? প্রশ্ন শুনে প্রথমে খানিক চুপ। তার পরে এক জন নিচু গলায় বলেন, “প্রথম দিকে কয়েক জনকে বলেছিলাম। রাজি হননি। কেউ কেউ বলেছেন, চেম্বার-নার্সিংহোম বন্ধ, টাকা কোথা থেকে দেবেন।” শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের সুপার শচীন্দ্রনাথ সরকার বলছেন, “ওঁদের এ ভাবে এগিয়ে আসাটা সত্যিই অভাবনীয়। ওঁদের অনেক ধন্যবাদ জানাই।” হাসপাতালও কি সাহায্য করতে পারে না? সুপার বলেন, “এ ক্ষেত্রে টাকা দেওয়ার মতো কোনও সংস্থানই হাসপাতালের নেই।’’

তাতে অবশ্য কিছু আটকাচ্ছে না। বরং হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন মানুষজনও চালকদের সঙ্গে পরিচিতির সূত্রে দুশো-পাঁচশো টাকা, চাল-ডিম ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে। রোগীর স্বজনেরাও যে সকলেই খেয়ে-দেয়ে হাত ধুয়ে চলে যাচ্ছেন, এমনটাও নয়। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকাও দিচ্ছেন কেউ-কেউ। একশো, দুশো... এক জন তো খুশি হয়ে একেবারে এক হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছেন! যদিও মূল খরচটা টেনে চলেছেন অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা, যাঁদের নিজেদেরই রোজগার এখন তলানিতে।

মাকে ভর্তি করে গত কয়েক দিন হাসপাতাল চত্বরেই পড়ে আছেন নাকাশিপাড়ার রতন ঠাকুর। তিনিও দিয়েছেন আড়াইশো টাকা। রতন বলেন, “রোগীর অভুক্ত আত্মীয়দের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা যা করছেন, বলার নয়। নইলে আমরা কী করতাম! অন্য হাসপাতালও ওঁদের দেখে শিখতে পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন