কাঁচা ইলিশের ঝোলে শুরু, পাঁঠার অম্বলে শেষ

নববর্ষের খাওয়াদাওয়া হত জোড়াসাঁকো বাড়ির দোতলার টানা বারান্দায়। কার্পেটের আসন লম্বা করে বিছিয়ে তার সামনে মাটির খুরিতে সাজানো থাকত খাবার। লিখছেন সুতপা সাহানববর্ষের খাওয়াদাওয়া হত জোড়াসাঁকো বাড়ির দোতলার টানা বারান্দায়। কার্পেটের আসন লম্বা করে বিছিয়ে তার সামনে মাটির খুরিতে সাজানো থাকত খাবার। লিখছেন সুতপা সাহা

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৩৬
Share:

উৎসব রবীন্দ্রনাথকে বরণ।

অনেক দশক আগের এক বৈশাখ মাস। সেই বৈশাখে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশে পা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ নৃপময়ীর মেজো মেয়ে রন্ধনপটিয়সী প্রজ্ঞাসুন্দরী, যার বিয়ে হয়েছিল অহমিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সংগে, তাঁর তৈরি অদ্ভুত নামের সমস্ত রান্না যেমন, ‘দ্বারকানাথ ফিরনি পোলাও’, ‘রামমোহন দোল্‌মা ভাত’, ‘সুরভী পায়েস’ ইত্যাদির সঙ্গে সেই নববর্ষে যুক্ত হল আরও একটি নতুন পদ। কবির জন্ম মাসে প্রজ্ঞাসুন্দরীর নতুন উদ্ভাবন— শীতশেষের ফুলকপি, খোয়া ক্ষীর, বাদাম-কিসমিস, জাফরান আর সোনা-রূপার তবক দিয়ে তৈরি বরফি (শোনা যায় বাদাম জাতীয় মিষ্টি নাকি কবির অত্যন্ত পছন্দের ছিল)। তিনি তার নাম দিলেন ‘কবি-সংবর্ধনা বরফি’। রবীন্দ্রনাথ যেমন জানতেন —‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়’, তেমনই রসনাতৃপ্তিকে কেন্দ্র করে বাঙালির নববর্ষ উৎসবের যে বিপুল আয়োজন, তারও সূত্রপাত উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের পরিবারেই।

Advertisement

ঠাকুরবাড়ির নববর্ষ উৎসবের অনুকরণে শহর কলকাতা এবং পরবর্তী সময়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসবের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। পয়লা বৈশাখে কবির ভাষাতেই ‘হে নূতন’ বলে নতুন বছরকে বরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি বরণ করে নেয় রবীন্দ্রনাথকেও। নববর্ষের পরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে পঁচিশে বৈশাখ, তারপর মাসাবধি কবিপক্ষ ঘিরে চলতে থাকে বাঙালির রবীন্দ্রযাপন। শ্রদ্ধায় স্মরণে ভালোবাসায় তিনিই এখনও বাঙালির উৎসবের প্রাণকেন্দ্র, বর্ষবরণ পালিত হয় তাঁরই রচিত গানে, নৃত্যে, আবৃত্তিপাঠে, নাটকের চর্চায়। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মহড়া দু’বেলা বসত অবনঠাকুরের দোতলার বড় ঘরে। জমজমাট মহড়া—দিনদা ( দিনেন্দ্র ঠাকুর) তো আছেনই , কখনও কখনও ইন্দিরাদেবী, নলিনীদেবী, মনীষাদেবীও গান শেখাতেন।

অবনবাবুর কন্যা সুরূপা, গগনঠাকুরের কন্যা হাসিদেবী সবাই অভিনয় ও গানে যোগ দিতেন। পয়লা বৈশাখের খাওয়াদাওয়া হত বাড়ির দোতলার টানা বারান্দায়। তেতলায় থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। টানা বারান্দায় মেঝেতে কার্পেটের আসন লম্বা করে বিছিয়ে তার সামনে কলাপাতা ঘিরে মাটির খুরিতে খুরিতে সাজানো থাকতো—কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ এবং আরও নানাবিধ সুস্বাদু খাবার।

Advertisement

শেষ পাতে থাকত দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রিয় খাবার—পাঁঠার হাড়ের অম্বল। ‘বৃহৎ রূপার থালে পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে / মাংসের পোলাও গাদা গাদা / কি গুণ পাঁঠার হাড়ে, অম্বলের তার বাড়ে / কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।’

আসলে ঠাকুরবাড়িতে রান্না নিয়েও নিত্যনতুন চর্চা হত, নানা ধরনের খাবার তৈরির প্রচলন ছিল। যার প্রতিফলন ঘটত উৎসবের দিনের খাবারের ফর্দে। মৃণালিনীদেবী রান্না করছেন আর পাশে একটা মোড়ায় বসে রবীন্দ্রনাথ নতুন রান্নার ফরমায়েশ করে তার মালমশলা হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছেন—এ ছিল ঠাকুরবাড়ির পরিচিত ছবি।

নিত্যনতুন রান্না খেতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ—দইয়ের মালপো, পাকা আম দিয়ে তৈরি মিষ্টি, চিঁড়ের পুলি। মৃণালিনীর তৈরি নববর্ষের জনপ্রিয় মিষ্টি ‘এলোঝেলো’ কবির খেতে লাগত বেশ, কিন্তু নামটা তেমন পছন্দ না হওয়ায় বদলে তার নতুন নাম দিলেন ‘পরিবন্ধ’। একবার বৈশাখের উৎসবে মৃণালিনীকে দিয়ে মানকচুর জিলিপিও তৈরি করিয়েছিলেন। বাঙালির পালাপার্বণ মানেই যে নানা ধরনের খাওয়া দাওয়া এটা পুরোনো সময় থেকেই প্রমাণিত সত্য।

সে দিন অন্তর্জাল ঘাঁটতে গিয়ে দেখি এই প্রজন্মের অনুজ কবি সৌভনিক বর্ষশুরুর দিনের রসনাতৃপ্তির জন্য এক বিশাল ফর্দ পোস্ট করেছেন—কাসুন্দি দিয়ে পাটপাতার ঝোল, ছোলা ও ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, পুঁইপিটুলির চচ্চড়ি, সজনে শাকভাজা রসুন দিয়ে, কচি লাউয়ের ডগা দিয়ে মটর ডাল, মুসুরি ডালের বড়া দিয়ে মোচাঘণ্ট, ডুমুর আলুর রসা, বকফুল আর পাটপাতার বড়া জাতীয় মহার্ঘ সব পদ। সৌভনিক আরো একটি পদের উল্লেখ করেছেন, এঁচোড় আর মুসুরি ডাল বেটে বড়া করে এঁচোড়ের রসকদম্ব। যা মনে করিয়ে দিল প্রজ্ঞাসুন্দরীর হাতে তৈরি পদ, গাছপাঁঠা সহযোগে পাঁঠার ব্যঞ্জন। গুরুদেবকে বিশেষ উৎসবের দিনে তিনি রান্না করে খাওয়াতেন এই পদটি।

এই সমস্ত পদগুলির বেশির ভাগই আজ, এই মুহূর্তে বাঙালির রান্নাঘরে হয়তো বা দুষ্প্রাপ্যই, খানিকটা অপরিচিতও। স্মৃতির অতলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বর্ষবরণ ঘিরে পুরোনো অনেক কিছুই। নববর্ষের প্রাক্কালে চৈত্রসংক্রান্তির দিবাগত রাতে নতুন ঘটে জল ঢেলে তাতে আতপ চাল ভিজিয়ে রেখে কচিপাতাযুক্ত আমগাছের চিকন ডাল ভিজিয়ে রাখা হত। পর দিন সকালে বাড়ির সবাইকে সেই ভেজানো চাল খেতে দিয়ে, আমের ডাল জলে ভিজিয়ে সবার শরীরে ও ঘরের চারদিকে ছড়ানো হত সার্বিক মঙ্গলকামনায়। ছোট বড় সকলের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে পুজোর জলখাবারে দেওয়া হত নুন আর আদাকুচি দিয়ে মাখা মুগডাল ভিজে, নুনলেবু দিয়ে মাখা শশা নারকোল, কাঁঠালি কলা, দই মিষ্টি ইত্যাদি।

উপাচারেও হারিয়ে গিয়েছে বৈশাখের পুরোনো সুখস্মৃতি—নেড়াপোড়া, তালপাতার হাতপাখা, বেতের ফুলের সাজি, বেলফুল। আছে শুধু স্মৃতি আর শান্তিনিকেতন।

অনেক দশক আগে এক পয়লা বৈশাখের বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় এসেছিল শান্তিনিকেতনে। সকালে আম্রকুঞ্জে গুরুদেব নববর্ষের ভাষণ দিয়েছিলেন। সে দিনই যখন বৈকালিক চা-পর্ব শেষ হয়েছে, এমন সময় ঘন মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ... দিগন্ত ধুলোয় ঢেকে ছুটে এল ঝড়। হঠাৎ দিনদা চেঁচিয়ে উঠলেন—ওই দেখ রবিকাকা আসছেন, ঝড়ের মধ্য দিয়ে ছুটে আসছেন রবীন্দ্রনাথ, চুল উড়ছে, জোব্বাটা চেপে ধরেছেন বাঁ হাতে আর ডান হাতে চেপে ধরেছেন চোখের চশমাটা...গলা ছেড়ে তিনি গাইছেন, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন