গবেষণায় সাফল্য, আর্সেনিক ঢুকবেই না ‘মুক্তশ্রী’ ধানে

আর্সেনিক প্রভাবিত সব এলাকায় এখনও আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়নি। ভূগর্ভস্থ জল বাঁচাতে ওই সব এলাকায় চাষের কাজে অগভীর নলকূপ বসানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেও তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আর্সেনিক পীড়িত মানুষদের কিছুটা রেহাই দিতে এগিয়ে এল রাজ্য সরকারের ধান গবেষণাকেন্দ্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
Share:

আর্সেনিক প্রভাবিত সব এলাকায় এখনও আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়নি। ভূগর্ভস্থ জল বাঁচাতে ওই সব এলাকায় চাষের কাজে অগভীর নলকূপ বসানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেও তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আর্সেনিক পীড়িত মানুষদের কিছুটা রেহাই দিতে এগিয়ে এল রাজ্য সরকারের ধান গবেষণাকেন্দ্র।

Advertisement

কী ভাবে?

রাজ্য কৃষি দফতরের দাবি, রাজ্য সরকারের ওই গবেষণাকেন্দ্র এমন এক প্রজাতির চাল তৈরি করেছে যা জলের সঙ্গে আসা আর্সেনিক বর্জন করে। অর্থাৎ ওই চালের মধ্যে আর্সেনিক ঢুকতেই পারে না। ওই ধানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মুক্তশ্রী’।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের সাত জেলা এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক মেলার পরে সেই আর্সেনিক জলের সঙ্গে মিশে ফসলের মধ্যে পৌঁছচ্ছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ওই গবেষণায় তারা দেখে, আর্সেনিক প্রভাবিত এলাকার ধান বা অন্য ফসলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক সঞ্চিত থাকছে। ওই আর্সেনিক চালের সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের শরীরে। আর্সেনিক-প্রভাবিত এলাকার চাল আর্সেনিক-মুক্ত এলাকার মানুষ খেলে তাঁদের শরীরেও আর্সেনিক ঢুকে যাচ্ছে বলে অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছেন গবেষকেরা। চালের মাধ্যমে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক যাতে না ছড়ায় তার জন্য এফএও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থাকে নতুন প্রজাতির ধান উৎপাদনে নজর দিতে বলেছিল। সেই কাজ শুরু হয়েছিল রাজ্য সরকারের ধান গবেষণা কেন্দ্রেও। ‘মুক্তশ্রী’ ধান সেই গবেষণারই ফসল।

রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু জানিয়েছেন, আর্সেনিক প্রভাবিত এলাকায় ওই বিশেষ প্রজাতির ধানের বীজ দেওয়া শুরু করেছে কৃষি দফতর। কৃষি দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, রাজ্যের ৮১টি ব্লকের ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে আর্সেনিক-দুষ্ট জল দিয়ে চাষ হয়। সেই সব জমিতে ‘মুক্তশ্রী’ ধানের বীজ লাগাতে পরামর্শ দিয়েছে কৃষি দফতর। কৃষি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই বীজ থেকে ধান হতে সময় লাগবে ১২৫ থেকে ১৩০ দিন। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি গাছে অনেক বেশি ধান হবে।

চুঁচুড়ার ধান গবেষণা কেন্দ্রে যে কৃষিবিজ্ঞানী এই নতুন প্রজাতির ধানের জনক সেই বিজন অধিকারীর দাবি, এই ধান এক দিকে যেমন আর্সেনিক প্রতিরোধ করবে, অন্য দিকে কৃষকের গোলাতেও বেশি ফসল উঠবে। বিজনবাবু জানাচ্ছেন, ২০০৫ সাল থেকে ২০০-র বেশি প্রজাতির ধানের বীজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ছ’বছরে ‘মুক্তশ্রী’-র জন্ম। ২০১৩ সালে ধানটির নামকরণ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক সূত্রের খবর, ‘মুক্তশ্রী’ বিশ্বের একমাত্র উচ্চ ফলনশীল আর্সেনিক প্রতিরোধকারী ধান। লখনউ বোটানিক্যাল রিসার্চ ইন্সস্টিটিউটের সহযোগিতায় এই গবেষণার কাজ করেছে চুঁচুড়ার প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘নেচার’ পত্রিকায় বিজনবাবু ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাগারে উৎপন্ন ওই ধান যে-কোনও মাঠে লাগিয়ে কি পরীক্ষা করা হয়েছে? বিজনবাবু বলেন, ‘‘এই ধরনের গবেষণায় যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা মাঠে ফসল ফলিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হচ্ছি, ততক্ষণ আমরা তা প্রকাশ্যেই আনি না।’’ আর্সেনিক প্রভাবিত উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা, বাংলাদেশের যশোহর-সংলগ্ন গ্রাম পিপলি, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, নদিয়ার বীরনগর, বর্ধমানের পূর্বস্থলিতে পরীক্ষামূলক ভাবে ওই ধানের চাষ করা হয়েছে। পরীক্ষায় ‘মুক্তশ্রী’ পুরোপুরি সফল বলেই রাজ্যের কৃষিমন্ত্রীর দাবি। এর পরেই বরো মরসুমে ওই ধানটি আর্সেনিক প্রভাবিত জেলায় ব্যাপক ভাবে
চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য কৃষি দফতর।

বিজনবাবু বলেন, ‘‘বরো মরসুমেই ভূগর্ভস্থ জল তুলে চাষের কাজ করেন কৃষকেরা। ভূগর্ভ থেকে যত বেশি জল তোলা হয়, ততই জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই বরো মরসুমে সেচের পাম্প চালিয়ে জল তুললেও ‘মুক্তশ্রী’ ধানের গাছে আর্সেনিক আর ঢুকবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন