এ বছর মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে ফিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এ বার রাজ্যের শিল্পায়নে সবচেয়ে বেশি নজর দেবেন তিনি। বিনিয়োগ টানতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই সিঙ্গাপুর, লন্ডন, জার্মানি গিয়েছেন। নভেম্বরের শেষে যাওয়ার কথা ব্যাঙ্কক সফরেও। আর এরই মধ্যে সোমবার শিল্পবান্ধব রাজ্যগুলির তালিকা প্রকাশ করল কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ঠাঁই পেয়েছে ১৫ নম্বরে। আগের বছরের ১১তম স্থান থেকে নেমে গিয়েছে আরও চার ধাপ।
বিশ্বব্যাঙ্কের সাহায্যে তৈরি এই রিপোর্টে স্পষ্ট, লগ্নিকারীদের সামনে রাজ্যের ভাবমূর্তি পাল্টাতে বিদেশে গিয়ে বৈঠকের পাশাপাশি প্রশাসনিক স্তরেও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে। বিশেষত শিল্পের জন্য এক-জানলা ব্যবস্থা কার্যকর করা, সহজে জমির বন্দোবস্ত, লাল ফিতের ফাঁস আলগা করার মতো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়তে হবে তাঁকে।
কোনও রাজ্যে শিল্প গড়া ও ব্যবসা করা কত সহজ, তা খতিয়ে দেখে গত বছর থেকে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করছে বাণিজ্য মন্ত্রক। লক্ষ্য, এ নিয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি। যাতে সার্বিক ভাবে সারা দেশে ব্যবসার পথ সহজ হয়। সেখানে দেখা হয়, শিল্পের জমি মসৃণ করতে কে সংস্কারের কেমন কাজ করছে। গত বছর এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ ছিল ১১ নম্বরে। এ বার পিছিয়েছে চার ধাপ। আগের বার পিছিয়ে থাকা তেলঙ্গানা, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যগুলি উঠে এসেছে প্রথম দশে। যুগ্ম ভাবে প্রথম অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা। তাদের ঠিক পিছনেই গত বারের এক নম্বর গুজরাত।
কেন্দ্রীয় শিল্পসচিব রমেশ অভিষেক বলেন, ‘‘জমির বন্দোবস্ত, নির্মাণের অনুমতি, এক-জানলা ব্যবস্থা, অনলাইনে কর জমা, পরিবেশ ছাড়পত্র, সহজে তথ্য জোগান ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, শ্রম ক্ষেত্রের মতো দশটি ক্ষেত্রে ৩৪০টি সংস্কারের কাজ নির্ধারিত হয়েছিল। রাজ্যগুলির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কোথায় কতখানি কাজ হয়েছে, তার বিচার করে স্কোরকার্ড তৈরি হয়েছে।’’ এতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি ৮৪.২৩%। অন্ধ্র ও তেলঙ্গানার স্কোর ৯৮.৭৮%। রমেশের বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক ও আমলা স্তরের নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হয়ে উঠেছে।’’
রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩৪০টি সংস্কারের কাজের মধ্যে এ রাজ্যের ৫৩টি কাজ বাকি। যেমন, শিল্পের জন্য জমির বন্দোবস্ত, এক-জানলা ব্যবস্থা চালু ইত্যাদি। জমি বরাদ্দের আবেদনে মঞ্জুরি দেওয়ায় সময়সীমা বাঁধা হয়নি। জমির রেকর্ড অনলাইনে দেখার বন্দোবস্ত নেই। পুরসভা, ভূমি দফতর, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরির কাজও হয়নি। নতুন শিল্পকে ছাড়পত্র দিতে পশ্চিমবঙ্গ আগেই এক-জানলা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। কিন্তু রিপোর্ট বলছে, ওই ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন দফতর থেকে উচ্চপদস্থ অফিসারকে যথোচিত ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগের কাজ হয়নি। হয়নি এক-জানলা ব্যবস্থা রূপায়ণের জন্য নানা দফতরের অফিসারদের নিয়ে আলাদা অফিস তৈরির কাজও।
তবে গত বারের মতো এ বছরও কর ব্যবস্থার সংস্কারে ভাল কাজ করা রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। স্থান পেয়েছে সেরা পাঁচে। ফল ভাল হয়েছে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ও শ্রম সংস্কারে। একই ছবি তথ্যের জোগান ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতাতেও। সেখানেও রাজ্য সেরা পাঁচে।
রাজ্য এই তালিকাকে তেমন গুরুত্ব দিতে নারাজ। শিল্প দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ধরনের তালিকায় এগোনো-পিছনো থাকেই। এ বার বিশ্বব্যাঙ্কের তালিকায় ভারত এক ধাপ উঠেছে। তার পরে মোদী সরকারই এ ধরনের তালিকাকে গুরুত্ব দিতে চাইছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফরে ও কলকাতার আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনে যে ধরনের সাড়া মিলেছে, তাতে স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গ লগ্নির অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে।’’ নবান্নের একটি সূত্র বাণিজ্য মন্ত্রকের এই তালিকার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। যুক্তি, প্রথম দশটি রাজ্যের সাতটিই বিজেপি শাসিত। যুগ্ম ভাবে প্রথম স্থানে থাকা দু’টি রাজ্যের মধ্যে অন্ধ্রের শাসক দল তেলুগু দেশমও এনডিএ-র শরিক। এর বাইরে শুধু তেলঙ্গানা, উত্তরাখণ্ড।
কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের দাবি, ‘‘রাজনৈতিক রং দেখে তালিকা তৈরি হয়নি। এর জন্য পৃথক পোর্টালে রাজ্যই তথ্য দিয়েছে। ফলে কে কোথায় এগিয়ে বা পিছিয়ে, তা সব রাজ্যের সামনে স্পষ্ট ছিল।’’
নবান্নের ওই সূত্র বলছেন, তামিলনাড়ুর মতো শিল্পোন্নত রাজ্যও এ বার পশ্চিমবঙ্গের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কর্নাটকের মতো রাজ্য মাত্র দু’ধাপ এগিয়ে। নির্মলার যুক্তি, যারা আগে এগিয়েছিল, সহজ সংস্কারের কাজ তাদের সারা। এখন কঠিন সংস্কারগুলি করতে সময় লাগছে। পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির এগোনোর সেটিও কারণ বলে তাঁর দাবি।