ফাইল চিত্র।
বিধানসভা ভোটের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে পাঁচ লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরির। রাজ্যের দাবি, সেই কথা রাখতে তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেই শিল্পায়নকে পাখির চোখ করে এগোতে শুরু করেছে তারা। কোথাও পুরনো প্রকল্পে গতি এনে, কোথাও নতুন লগ্নি টেনে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা, ‘‘সকলকে সরকারি চাকরি করতে হবে, এমন লক্ষ্য কেন হবে? যে কোনও কাজই কাজ।’’ প্রশাসনিক মহলের দাবি, ব্যবসা করতেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে।
বিরোধীদের তোপ, এ রাজ্যে লগ্নি আসে না। তাই কাজের সুযোগও তৈরি হয় না। মেধাবী পড়ুয়া ও দক্ষ কর্মীদের এক বড় অংশ ভিন্ রাজ্যে বা দেশে পাড়ি দেন। শিল্পের একাংশের অনুযোগ একলপ্তে বেশি জমির অভাব নিয়ে। যা বড় প্রকল্প তৈরির পথে বাধা। তাদের দাবি, তাতে ধাক্কা খায় কর্মসংস্থানও। তৃতীয় দফায় তো বটেই, সার্বিক ভাবে তৃণমূল জমানায় ফি বছরে গড়ে কত চাকরি হয়েছে, সেই হিসাব প্রায়শই চান বিরোধীরা।
তবে রাজ্য বলছে, গত ১০ বছরে বিশেষত ১০০ দিনের কাজ, ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পে (এমএসএমই) কর্মসংস্থান বেড়েছে। উদ্যোগপতি হতে উৎসাহ দেওয়ায় হাত ধরেও চওড়া হয়েছে রোজগারের পথ। এ বার সেই পথেই চলার গতি বাড়ানো চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি তাদের দাবি, দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্প রাজ্যের ডেউচা পাঁচামিতে সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে ১ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। সারা রাজ্যে শিল্পতালুক গড়ার ক্ষেত্রে জমির ঊর্ধ্বসীমায় ছাড়ের সুবিধা বলবৎ হওয়ায় লগ্নি উৎসাহিত হবে। আর তার হাত ধরেও বাড়বে কাজ। করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে এ সব সম্ভব বলেই মনে করছে রাজ্য।
সরকারি সূত্রের দাবি, ইস্পাত, সিমেন্টের মতো বড় শিল্পের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষেবা নির্ভর ক্ষেত্রে (ডেটা সেন্টার) কাজের সুযোগ বাড়বে। অবশেষে প্রকল্পের কাজ শুরু করছে ইনফোসিস। সেটির প্রথম পর্যায়ে দু’হাজার কর্মসংস্থান হবে। শীঘ্রই ৫০০ জন কর্মী নিয়ে শাখা চালু করবে মাইন্ডট্রি।
শিল্পে রাজ্য আশার কথা বললেও, অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী গত নভেম্বরে প্রাথমিকে ১৬,৫০০ জন শিক্ষক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বিধানসভা ভোটের আগে হাজার পাঁচেক নিয়োগ হলেও, আইনি জটিলতায় প্রক্রিয়াটি সাময়িক থমকে যায়। ভোটের পরে ১০,৫০০ শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। উচ্চ প্রাথমিকে অবস্থা আরও জটিল। ১৪,৩৩৯টি শূন্য পদে নিয়োগ ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করতে হবে বলে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও, এখনও পর্যন্ত ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া হয়েছে। তাতে ডাক না-পাওয়া প্রার্থীরা অস্বচ্ছতার অভিযোগে মামলা করায় তাঁদেরও এখন স্কুল সার্ভিস কমিশনের অফিসে অভিযোগ শোনার প্রক্রিয়া চলছে। পশ্চিমবঙ্গ আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থী মঞ্চের সহ-সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘২০১৪ সালে উচ্চ প্রাথমিকে টেটের অফলাইন ফর্ম ভরেছিলাম। আইনি জটিলতায় বার বার নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ায় বহু যোগ্য প্রার্থী এখনও চাকরি পেলেন না।’’ বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘‘কেন প্রতি বছর স্বচ্ছ ভাবে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাটুকু নেওয়া যাবে না?’’
চলতি অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজে বিপুল ‘সাফল্য’ মিলেছে বলে দাবি জেলা প্রশাসনগুলির। যেমন, দক্ষিণ দিনাজপুরে প্রায় ১৪.৮০ লক্ষ শ্রমদিবস তৈরি হয়েছে। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে কাজ পেয়েছেন প্রায় ১০ লক্ষ জন। তবে হুগলিতে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন আর ১০০ দিনের কাজ ছাড়া কর্মসংস্থানের তেমন নতুন দিশা মেলেনি। ঝাড়গ্রাম জেলাতেও ভরসা বলতে ১০০ দিনের কাজ। উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর, হাবড়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় নির্মীয়মান কারখানা তৈরি হলে, চাকরির সুযোগ বাড়বে বলে আশায় সংশ্লিষ্ট মহল। প্রশাসনের দাবি, ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বেকারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলছে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানে। পুরুলিয়ায় কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্র মারফত চটকলে এ বছর শতাধিক জন কাজে বহাল হয়েছেন। বীরভূমেও মূলত ১০০ দিনের কাজই ভরসা। সেখানে ছ’লক্ষেরও বেশি ‘জব কার্ড হোল্ডার’ কাজ পেয়েছেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ও ভগবানপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে একশো দিনের কাজে তেমন গতি নেই। ঘাটালের বহু পঞ্চায়েতে লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ শ্রমদিবসও তৈরি হয়নি। পুজোর পরে কাজে গতি আনতে প্রশাসনিক উদ্যোগ শুরু হচ্ছে বলে খবর। বিরোধীদের অভিযোগ, ‘‘রোজগারের সুযোগ তৈরি বলতে কেন্দ্রের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প। তাতেও দুর্নীতির অভিযোগ!’’
রাজ্যে কর্মসংস্থানে কিছু সমস্যা থাকার কথা মানলেও অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকারের বক্তব্য, ‘‘অত্যন্ত দক্ষ কর্মী ভিত্তিক শিল্পে সাধারণত কর্মসংস্থান কম হয়। তাই বরাবরই রাজ্যের লক্ষ্য ছোট-মাঝারি শিল্প। যেখানে তুলনায় কম দক্ষ কর্মী হলেই চলে। অথচ কাজ পান অনেক বেশি মানুষ। আমজনতার বড় অংশের অন্তত পেট চালানোর মতো আয় হয়।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর দাবি, এমএসএমই ক্ষেত্র দক্ষ হলে, কাজের সুযোগ ও অর্থনীতির প্রসার ঘটে। তখন বড় লগ্নি টানাও সহজ হয়। কর্মসংস্থান বাড়ে।
বিরোধীদের একাংশের মতে, রাজ্যে উৎপাদনমুখী শিল্পের (কল-কারখানা) অভাবের জন্য বামেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠত, তা এড়াতে পারে না তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও। তার উপরে অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কাজ বাড়ছে। বাড়ছে ব্যবসা (ট্রেড)। শিল্পের শক্ত ভিতের বদলে শুধু এই সবের নির্ভর করে দীর্ঘ মেয়াদে কাজের বাজার সাধারণত মজবুত হয় না। তবে অভিরূপের মতে, বাংলা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ‘ট্রেড হাব’ (ব্যবসার কেন্দ্র) হিসেবে গড়ে উঠলে লাভ হবে। কারণ, কাজের সুযোগ তৈরি হবে তাতে ভর করে।
কতখানি? উত্তর দেবে সময়ই।