ওষুধে বছরে ২ কোটি, দিশাহারা পরিবার

হাওড়ার চামরাইলের বাসিন্দা সুমনের বয়স ২১। তিনি এমন এক রোগের শিকার যে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না। কানে কম শুনছেন, হজম করতেও অসুবিধা হচ্ছে। সপ্তাহে এক দিন করে ফুল বিক্রি করতেন। হাত-পায়ের যন্ত্রণা বাড়ায় তা-ও বন্ধ। চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে সুরাহা মেলার বদলে হতাশা বেড়েছে।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৭ ০১:১৯
Share:

পরিবারের সঙ্গে সুমন (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র

বাড়ির বড় ছেলে। ছেলেবেলায় বাবা সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মা অন্যের বাড়িতে রান্নার কাজ করে সংসার চালান। এক বোনের বিয়ে হলেও, বাড়িতে রয়েছে আরও তিন ভাই, এক বোন। ছ’জনের সংসারের ভার মায়ের উপরে। মাকে সাহায্য করতে চাইলেও শারীরিক কারণে কিছুই করতে পারেন না সুমন মল্লিক।

Advertisement

হাওড়ার চামরাইলের বাসিন্দা সুমনের বয়স ২১। তিনি এমন এক রোগের শিকার যে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না। কানে কম শুনছেন, হজম করতেও অসুবিধা হচ্ছে। সপ্তাহে এক দিন করে ফুল বিক্রি করতেন। হাত-পায়ের যন্ত্রণা বাড়ায় তা-ও বন্ধ। চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে সুরাহা মেলার বদলে হতাশা বেড়েছে। আগে জ্বর, সর্দি, হলে ওষুধে সেরেছে। কিন্তু ইদানীং যে সব উপসর্গ শুরু হয়েছে, তাতে চিকিৎসকেরা বেশ কিছু পরীক্ষার কথা বলেছেন। তা করাতে গেলে দিল্লি যেতে হবে। খরচ অনেক। তাতেও যে ওষুধ মিলবে, তেমনও নয়। শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘সুমন দুরারোগ্য ‘হান্টার সিন্ড্রোম’-এর শিকার।’’ জিনঘটিত এই অসুখে শরীরে কোনও এনজাইম তৈরি হয় না। ফলে একটি করে অঙ্গ নষ্ট হতে থাকে। ত্রিশের কোঠায় শেষ হয় আয়ু! সুমন একা নন। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, তাঁর দুই ভাইও এর শিকার। কিছু দিনে আরও খারাপ হবে তাদের শরীরও।

বছর দশেক আগে অবশ্য ছবিটা আলাদা ছিল। খেলাধুলা, পড়া নিয়ে মেতে থাকতেন সুমন। শুধু মাঝেমাঝে জ্বর, সর্দি, লিভারের সমস্যা হতো। কিন্তু সুমনের বয়স ১০ পেরোতেই হাত-পায়ে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। প্রথমে তেমন পাত্তা দিতেন না। পরে পেটে ব্যথা শুরু হওয়ায় হাসপাতালে যান। বলা হয়, হার্নিয়া অস্ত্রোপচার করতে হবে। অস্ত্রোপচারের পরে আরও খারাপ হয় শরীর। সুমনের মা মায়ার কথায়, ‘‘মানসিক বৃদ্ধি হলেও হঠাৎ করে ওর শরীরের বৃদ্ধি থমকে গেল। হাত-পায়ের আঙুল বেঁকে বিকৃত হতে থাকে। চামড়া খসখসে, দাঁতের মাড়ি বড় হয়ে চেহারা অদ্ভুত হতে শুরু করে।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: মেয়েটির সারা শরীর ভেসে যাচ্ছিল রক্তে

শুরু হল নতুন লড়াই। আশায় বুক বেঁধে তাঁরা ছোটেন নানা হাসপাতােল। রোগের নামও বলতে পারেননি কেউ। দু’বছর আগে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ দ্বিতীয় বার হার্নিয়া অস্ত্রোপচারের সময়ে তাঁরা জানতে পারেন, এ রোগ সারার নয়।

যদিও সুমনের পরিবার জেনেছে, এই রোগের চিকিৎসা আছে। অপূর্ববাবু জানান, ‘‘এর চিকিৎসা বলতে এনজাইম রিপ্লেসমেন্ট। কিন্তু সে ওষুধ বা ইঞ্জেকশন আনাতে হয় আমেরিকা এক সংস্থার থেকে। একটি ফাইলের দাম প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। প্রতি সপ্তাহে ওষুধ দেওয়া মানে বছরে খরচ প্রায় ২ কোটি!’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দেশে এই রোগে আক্রান্ত ১৩০-এর উপরে। মাত্র ১২ জন চিকিৎসা পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে ৪ জন এই রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা হচ্ছে মাত্র এক জনের।

এ দিকে সুমন এখন প্রায় শুনতে পান না। সঙ্গে বুকে চাপ লাগে। হাঁফিয়ে পড়েন অল্পেতেই। একাধিক পরীক্ষার পাশাপাশি ‘হিয়ারিং-এড’ নিতে বলেছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু টাকা? তা আসবে কোথা থেকে? সুমন বলেন, ‘‘রোগের জন্য একাদশ শ্রেণির পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। চেষ্টা করছি সরকারি প্রতিবন্ধী কার্ডটা করিয়ে যদি কিছু করতে পারি। তা হলে অন্তত কিছু একটা উপায়ে রোজগার করতে পারব।’’

সুমন এ কথা বললেও আশা দেখছেন না তাঁর মা মায়া মল্লিক। তাঁর কথায়, ‘‘জানি না কী করব। সুমনের তো তা-ও চিকিৎসা করাচ্ছি। বাকি দুই ছেলের চিকিৎসা শুরুই করতে পারিনি। সুরজিতের হার্নিয়া অস্ত্রোপচার করাতে হবে। বিশ্বজিৎ মাঝেমাঝে দিনভর অজ্ঞান থাকে।’’

সুমন প্রতিবন্ধী কার্ড করিয়ে কাজ করার কথা ভাবলেও তা যে সম্ভব নয়, বুঝছে পরিবারও। কারণ, রোগের উপসর্গ হিসেবে একে একে অঙ্গ বিকল হবে। ধীরে ধীরে ফুরোবে আয়ুও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন