দলীয় নেতৃত্বের উপরে তাঁর অসন্তোষ অনেক দিনের। ঘনিষ্ঠ মহলে সেটা চাপাও থাকত না। কিন্তু এ বার সেটা প্রকাশ্যে ফেটে পড়ছে। দীনেশ ত্রিবেদীর ভাবগতিক দেখে অনেকেই মনে করছেন, তৃণমূলে আরও একটি উইকেটের পতন প্রায় নিশ্চিত।
কেন?
গত সপ্তাহে গুজরাতের কচ্ছ জেলার মাণ্ডবীতে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করে এসেছেন এই তৃণমূল সাংসদ। মোদীর বড়ভাই সোমভাই মোদীর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশের ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছেন। মোদী সরকারকে সমর্থন করাই এখন ‘বুদ্ধিমানের কাজ’।
এতেও থামেননি দীনেশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, নিজেদের মধ্যে ‘ব্যক্তিত্বের সংঘাতে’ পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের সোনার সুযোগ হারিয়েছে তৃণমূল। তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গের হাল ফেরাতে হলে অবিলম্বে হিংসার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। শিক্ষাঙ্গন থেকে দলীয় পতাকা সরাতে হবে। তাঁর ইঙ্গিত যে নিজের দলের কাজকর্মের দিকেই, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যাওয়ার অভ্যাস দীনেশের অবশ্য নতুন নয়। তিন বছর আগে রেলমন্ত্রী থাকার সময় নেত্রীর জনমোহিনী নীতিকে অগ্রাহ্য করে রেলের ভাড়া বাড়িয়েছিলেন। খেসারত হিসাবে তাঁকে মন্ত্রকের দায়িত্ব হারাতে হয়। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে সর্বদাই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গিয়েছেন দীনেশ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় মমতার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করার ডাকও দিয়েছিলেন। কিন্তু দল ছাড়ার মতো জায়গা তখনও আসেনি। গত লোকসভা নির্বাচনে দীনেশ ব্যারাকপুর থেকে তৃণমূলের টিকিটেই জিতেছেন।
কিন্তু এ বারের বিদ্রোহের তাৎপর্য আলাদা। খোদ গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে দীনেশ এখন যখন সুর চড়াচ্ছেন, তখন সারদা-সহ নানা ঘটনায় মমতার দল ও সরকারের নাজেহাল দশা। এক মন্ত্রী মদন মিত্র জেলে। আর এক মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর রাতারাতি ইস্তফা দিয়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। সিবিআইয়ের তলব পেয়েছেন মুকুল রায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, দীনেশের বিদ্রোহের পরিণতি তবে কী?
উত্তরটা আন্দাজ করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। বিজেপি এবং তৃণমূল, দু’দলেরই অন্দরের খবর, মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর একা নন। দীনেশ-সহ দল ছেড়ে দেওয়ার লাইনে রয়েছেন অনেক নেতাই। দলত্যাগবিরোধী আইন বাঁচিয়ে প্রথমেই ইস্তফা না দিয়ে তাঁরা দলের ভিতরে একটি পৃথক মঞ্চ গড়তে পারেন বলেও খবর। দলের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা আগে যিনি সামলাতেন, সেই মুকুল নিজেই প্রবল ভাবে কোণঠাসা। ফলে ভাঙনের ছবিটাই আগামিদিনে স্পষ্ট হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও তৃণমূলের তরফে দাবি, এমন সব জল্পনার কোনও অবকাশ নেই। আজ টিটাগড় পুরসভার একটি অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন দীনেশ। সেখানে তিনি কোনও রকম দলবিরোধী কথা বলেননি।
আবার রাজনীতির আর একটি সূত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে, গত সপ্তাহে দীনেশ একটি গুজরাতি সংবাদপত্রে (জন্মভূমি) সাক্ষাৎকার দেন। যেখানে তিনি বলেন, ইজরায়েল, জাপান, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের সামনে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মোদী। এই সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তগুলি সমর্থন করলে দেশের উপকারই হবে।
দীনেশ এমনিতে কচ্ছেরই ভূমিপুত্র। সেখানকার ‘বিদিদা সর্বোদয় ট্রাস্ট’ প্রত্যেক বছর বিশাল মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করে, যার অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। গত সপ্তাহে এই অনুষ্ঠানে দীনেশের সঙ্গে হাজির ছিলেন মোদীর বড় ভাই। সেই উপলক্ষেই ওই সাক্ষাৎকার। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সেখানে আরও বলেছেন, ‘যখন দেশ সামনে এগোচ্ছে তখন সরকারের প্রতি বিরোধী দলগুলির নেতিবাচক ভূমিকা উন্নয়নের পথে বড় প্রতিবন্ধক।’ মুখ্যমন্ত্রীর নাম না-করে তাঁর মন্তব্য, “বাংলার উন্নতি করার একটা সোনার সুযোগ পেয়েছিল তৃণমূল। ব্যক্তিত্বের সংঘাতে ভেস্তে গেল।” দীনেশের দাবি, ‘চামচাবাজি’ তাঁর ধাতে নেই। সঠিক কথা বলতে তিনি ভয় পান না।
কিন্তু কী ভেবে তিনি মোদীর স্তুতি করলেন? তাঁর ব্যাখ্যা চাওয়া হলে দীনেশ পরে বলেছেন, “আমি বলেছি যে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সেবা করার সুযোগ এসেছে। রেলের মন্ত্রিত্ব যখন ছেড়েছিলাম, তখনও বলেছিলাম দেশ আগে, দল পরে। আজও তাই বলছি।”
রাজনীতির ময়দানে বেশির ভাগই অবশ্য দীনেশের কথাগুলিকে এত সরল ভাবে নেওয়ার পক্ষপাতী নন। তাঁরা বরং উল্লেখ করছেন, দীনেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। তুলনায় তৃণমূলের হয়েই তাঁর সক্রিয়তা দিনদিন কমছে। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতার নির্দেশ অমান্য করে রেলভাড়া বাড়ানোর পরই নেত্রীর কোপে পড়েন তিনি। তারপর থেকেই দীনেশ দলে অনেকটা পিছনের সারিতে চলে যান। সংসদের সদ্যসমাপ্ত শীতকালীন অধিবেশনে লাগাতার ধর্নায় তিনি উপস্থিত থেকেছেন বটে, কিন্তু অনিয়মিত। একেবারে পিছনের সারিতে দায়সারা ভাবে।
বরং কচ্ছের রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, দীনেশ শুধু নিয়মিত সেখানে যাতায়াতই করেন না, তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে সেখানকার কলেজ রোড গঠনের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ সাহায্যও করেছেন। তিনি হয়তো প্রকাশ্যে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন না, কিন্তু কার্যকরী যোগাযোগ রেখে চলেন। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেও তিনি মোদীর প্রশস্তি করেছিলেন।
বিজেপি শিবিরের একাংশের মতে, বিচক্ষণ দীনেশ বুঝে গিয়েছেন যে আজকের তৃণমূলে তাঁর ঠাঁই নেই। তুলনায় কচ্ছ এলাকায় তেমন কোনও প্রভাবশালী বিজেপি নেতা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এই মুহূর্তে সাংসদ পদ না ছাড়লেও আগামিদিনে তিনি বিজেপির টিকিটে কচ্ছে জিতলে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারবেন। সেই রাজনৈতিক অঙ্ক দীনেশের মাথায় রয়েছে বলেই জল্পনা রাজধানীতে।