বুধবার ঝাড়গ্রাম আদালতে ছিতামণি মুর্মু। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
যাঁর উপরে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগকে ঘিরে লালগড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল বলা চলে, সেই ছিতামণি মুর্মুই আর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে চান না। পেশায় দিনমজুর পঞ্চাশোর্ধ্ব এই আদিবাসী প্রৌঢ়া বুধবার ঝাড়গ্রাম দ্বিতীয় এসিজেএম-এর আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “তখন পুলিশ গ্রামে গ্রামে অত্যাচার চালাত। সরকার বদলে যাওয়ার পরে পুলিশ আগের মতো নেই। পুলিশ এখন আমাদের বন্ধু। তাই পুলিশের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই।”
লালগড় আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল লালগড়ের ছোটপেলিয়ার বাসিন্দা ছিতামণিকে, বা বলা ভাল, তাঁর চোট লাগা বাঁ চোখকে। মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি পর্যন্ত তখন বলেছিলেন, “ছিতামণি মুর্মু এক ঐতিহাসিক নাম।” ২০১১-র নভেম্বরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কিষেণজি নিহত হন। আর এখন মমতার সরকারের পুলিশের বিরুদ্ধে ছিতামণির অভিযোগ নেই।
২০০৮-এর ২ নভেম্বর শালবনিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাইন ফাটে। অল্পের জন্য রক্ষা পান বুদ্ধবাবু ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান। ৫ নভেম্বর গভীর রাতে ছোটপেলিয়া গ্রামে করণ হেমব্রম নামে এক মাওবাদী নেতা ও তার সঙ্গীদের খোঁজে যায় পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রামের আদিবাসী মহিলাদের নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। পুলিশের বন্দুকের নলের খোঁচায় ছিতামণিদেবীর বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে যায় বলেও অভিযোগ। ৬ নভেম্বর লালগড়ে রাস্তা কাটা, গাছ ফেলে পথ অবরোধ ও গাড়ি-বাস ভাঙচুরের মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলন। ছিতামণি সে দিন লালগড়ের দলিলপুর চকে বসে তাঁর রক্তাক্ত চোখ নিয়ে।
ওই বছর ২ ডিসেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন এসপি রাজেশ সিংহের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন ছিতামণি। তাঁর অভিযোগ ছিল, ঘটনার দিন লালগড় থানার আইসি সন্দীপ সিংহ রায়ের নেতৃত্বে তাঁর স্বামী গোরাচাঁদ মুর্মুকে বাড়ি থেকে বার করে পুলিশ। ছিতামণির শ্লীলতাহানি করা হয় এবং বন্দুকের নল দিয়ে তাঁর বাঁ চোখে খুঁচিয়ে দেওয়া হয়। ওই চোখের দৃষ্টি আর পুরোপুরি ফেরেনি। সেই সন্দীপ সিংহ রায় এখন কাকদ্বীপের সার্কেল ইনস্পেক্টর। কোর্টে ছিতামণির ওই বয়ান শোনার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “নতুন করে কিছু বলতে চাই না।”
ছিতামণির অভিযোগে লালগড় থানার পুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি) ও ৩২৫ (ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করা) ধারায় একটি মামলা রুজু করে। ৮ জুলাই মামলার তদন্তকারী বিকাশচন্দ্র পাত্র আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে জানান, ঘটনার দিন ছোটপেলিয়া গ্রামে কয়েক জন সন্দেহভাজনকে ধরতে গেলে জনতার সঙ্গে পুলিশের সামান্য ধস্তাধস্তি হয়। পুলিশ কাউকে আঘাত বা শ্লীলতাহানি করেনি। ওই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বক্তব্য জানার জন্য এ দিন ছিতামণিদেবীকে তলব করে আদালত। ছিতামণি করজোড়ে বিচারক টিকেন্দ্রনারায়ণ প্রধানকে জানান, পুলিশের রিপোর্ট নিয়ে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি আর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে চান না। ছিতামণিদেবীর কথায়, “তখন পরিস্থিতি অন্য ছিল।”
ছিতামণিদেবীর আইনজীবী কৌশিক সিংহ বলেন, “আদালতে পুলিশ যে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে, তার সঙ্গে ছিতামণিদেবীর অভিযোগের কোনও মিল নেই। তদন্ত করার মতো বিষয়বস্তু ছিল। কিন্তু আমার মক্কেল বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থাশীল হওয়ায় মামলাটি না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” সরকারি কৌঁসুলি কণিষ্ক বসু বলেন, “ছিতামণিদেবী আপত্তি না জানানোয় মামলাটি শেষ হয়ে গেল।”
কেন ছিতামণির এই পরিবর্তন? স্থানীয় সূত্রের খবর, গত লোকসভা ভোটের আগে থেকেই ছিতামণির পরিবার-সহ ছোটপেলিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শাসকদলের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করে। তাদের বিভিন্ন সভায় এখন ছিতামণি ও তাঁর বাড়ির লোকজনকে যোগ গিতে দেখা যাচ্ছে বলে তৃণমূল সূত্রের দাবি। ২০১১-র জুলাইয়ে মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলে তাঁর প্রথম সফরে গিয়ে ছিতামণির জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেও ওই প্রৌঢ়া প্রথমে তা নেননি। কয়েক মাসে আগে তিনি চেক নিয়েছেন বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
দলের অন্দরের খবর, ছিতামণি যাতে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেন, সে জন্য লালগড়ের এক তৃণমূল নেতা গত তিন-চার দিন ধরে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জেলা তৃণমূলের একাধিক নেতা অবশ্য বলেছেন, “ছিতামণির বক্তব্য একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব। এতে দলের কোনও ভূমিকা নেই।”
আদালত থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছিতামণি বলেন, “সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে আমরা এখন ভাল আছি। আমরা সরকারের পাশে আছি।”