বিগ্রহের মিলনমেলায় উত্সবের রং বারোদোলে

ছোট রানির মানভঞ্জন করতে যে মেলার সূচনা, সেই মেলাই হয়ে উঠল দেবতাদের পুনর্মিলন উৎসব। দোলযাত্রার রেশ কাটতে না কাটতেই চৈত্রের মাঝামাঝি আবারও রঙিন হয়ে উঠল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি প্রাঙ্গণ। দেব-দর্শনের পাশাপাশি সে মেলা হয়ে উঠল কৃষ্ণনগর তথা নদিয়ার মানুষের কাছে বিনোদন, মনোরঞ্জন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাবেচার এক অন্য ঠিকানা। কালের নিয়মে প্রাচীন এই মেলার কিছু জিনিস বদলালেও অনেক কিছু আজও অটুট রয়েছে। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য।

Advertisement

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ২৩:২৩
Share:

রাজবাড়ির উপর থেকে মেলার দৃশ্য।

ছোট রানির মানভঞ্জন করতে যে মেলার সূচনা, সেই মেলাই হয়ে উঠল দেবতাদের পুনর্মিলন উৎসব। দোলযাত্রার রেশ কাটতে না কাটতেই চৈত্রের মাঝামাঝি আবারও রঙিন হয়ে উঠল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি প্রাঙ্গণ। দেব-দর্শনের পাশাপাশি সে মেলা হয়ে উঠল কৃষ্ণনগর তথা নদিয়ার মানুষের কাছে বিনোদন, মনোরঞ্জন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাবেচার এক অন্য ঠিকানা। কালের নিয়মে প্রাচীন এই মেলার কিছু জিনিস বদলালেও অনেক কিছু আজও অটুট রয়েছে।

Advertisement

কিংবদন্তী, জনশ্রুতি আর আঞ্চলিক ইতিহাসের হাত ধরেই কৃষ্ণনগরের বারোদোলের মেলা বর্তমানে নিজেই একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। মেলা শুরু নিয়েও প্রচলিত আছে একটি কাহিনি।

সেই কাহিনি অনুসারে, ছোট রানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে উলায় মেলা দেখতে নিয়ে যেতে। রাজা তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, মেলা দেখতে নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু রাজকার্যে ব্যস্ত কৃষ্ণচন্দ্র শেষ পর্যন্ত রানিকে মেলা দেখাতে নিয়ে যাওয়ার সময় পাননি। কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারায় রাজার উপর ছোট রানি অভিমান করেন।

Advertisement

ছোট রানির মানভঞ্জনের জন্য তিনি ভাবলেন, রানিকে মেলায় না নিয়ে গিয়ে যদি মেলাকেই রানির কাছে নিয়ে আসা যায়? পণ্ডিত সমাজের কাছে তিনি পরামর্শ চাইলেন। পুঁথি-পত্র ঘেঁটে পণ্ডিত সমাজের গন্যমাণ্যরা বিধান দিলেন, ‘চৈত্রে সিত্যৈকাদশ্যাঞ্চ দক্ষিণাভিমুখং প্রভূম্। দোলয়া দোলনং কুর্যান্নীতনৃত্যা দিলোৎসবম্।’ অর্থাত্ চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্যগীত সহযোগে দেবদেবীকে দক্ষিণমুখে দোলায় বসিয়ে দোলাতে হয়। এর প্রমাণ মেলে হরিভক্তি বিলাসে। এ ছাড়াও গরুড় পুরাণেও উল্লেখ মেলে, চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দেবতাকে দক্ষিণমুখী বসিয়ে পুজো করে এক মাস দোলায় দোলাতে হয়।

পণ্ডিতদের দেওয়া এই বিধান কৃষ্ণচন্দ্রের মনে ধরেছিল। প্রচলিত দোল উৎসবের বেশ কয়েক দিন পরে এই দোল উৎসবকে কেন্দ্র করেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বাইরে, অথচ গড়ের মধ্য তিনি মেলার প্রচলন করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারির বিভিন্ন জায়গা থেকে এই উপলক্ষে বারোটি (মতান্তরে তেরোটি) বৈষ্ণব বিগ্রহ রাজবাড়িতে নিয়ে এসে শুরু হয়েছিল বিশেষ পুজার্চনা। এই সব বিগ্রহগুলিকে প্রথম দিন রাজবেশ, দ্বিতীয় দিনে ফুল-বেশ এবং তৃতীয় দিনে রাখাল-বেশে সাজিয়ে পুজোর প্রচলন হয়। তার থেকে লোক মুখে প্রচলিত হয়েছিল বারোদোল। আর সেই উপলক্ষেই এই বিশেষ মেলা।

এই মেলায় বর্তমানে যে যে বিগ্রহ মিলিত হন তাঁরা হলেন বলরাম, বড় নারায়ণচন্দ্র ও ছোট নারায়ণচন্দ্র, গোবিন্দদেব, গোপীমোহন, নদের গোপাল, গোপীনাথের প্রতিকৃতি, মদনগোপাল, লক্ষ্মীকান্ত ও কৃষ্ণচন্দ্র, নাড়ুগোপাল, গোষ্ঠবিহারী ও গড়ের গোপাল। এই সব বিগ্রহগুলিকে কাঠের সিংহাসনে বসিয়ে সেগুলিকে দোল দেওয়া হয়। ভক্তরা এই সকল বিগ্রহের পায়ে আবির দিয়ে যান। শুধু তাই নয়, নদিয়ার মানুষ তাঁদের বাড়ির গাছের প্রথম ফল এখানে দেবতাকে নিবেদন করতেন। আজও কিছু মানুষ সাবেক সেই প্রথা মেনে চলেন।

তবে গবেষকদের মতে, যে সময় এই মেলার প্রচলন সেই সময় বাংলার রাজনৈতিক তথা অথর্নৈতিক অবস্থা ছিল চিন্ত্যনীয়। এক দিকে বর্গি হামলায় বিপর্যস্ত বাংলা অন্য দিকে নবাবের রাজস্ব আদায়ের ক্রমাগত চাপ। এরই মাঝে সাধারণ মানুষের কাছে এই মেলা হয়ে উঠেছিল বিনোদন এবং কেনাবেচার এক টুকরো মরুদ্যান।

মেলার চেনা ছবি।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায় বলছিলেন, ‘‘১৭৪৪ সালে শুরু হওয়া এই মেলা নানা ভাবেই ব্যতিক্রমী। এই মেলা শুরুর পিছনে ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের গভীর দূরদর্শীতা। ছোট রানির মানভঞ্জন করতে শুরু হলেও নদিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতেও মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে যুগে শাক্ত-বৈষ্ণবদের মধ্যে রেষারেষি এবং বিদ্বেষ ছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই বারোদোলের প্রচলন করে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি শাক্ত হয়েও বৈষ্ণব উৎসব করছেন। অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে শাক্ত-বৈষ্ণবের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হোক। তেমনই রাজবাড়ির গড়ে মেলা বসায় অন্দরমহলের মহিলারা এই মেলাকে উপভোগ করতে পারতেন। সে কালে আজকের মতো দোকান বাজার না থাকায় এই মেলায় নদিয়ার বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন তাঁদের তৈরি জিনিস বিক্রির সুযোগ পেতেন, ঠিক তেমনই সাধারণ মানুষ নানা ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারতেন। ফলে মেলার একটা অর্থনৈতিক দিকও তৈরি হয়েছিল। শোনা যায়, এই মেলাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখন মেলা চলে মোট ৪১ দিন।’’

সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে ঐতিহ্যশালী এই মেলার ছবি। ক্যাঁচোরকোঁচর শব্দে আর ঘোরে না কাঠের নাগোরদোলা। তার জায়গা নিয়েছে জায়ান্ট হুইল কিংবা ইলেকট্রিক নাগোরদোলা। দেখা মেলে না তাল পাতার সেপাই, কাগজের কুমির, কিংবা পাথরের বাসনের। মেলায় মাটির পুতুল এলেও আগের মতো আর বেচা-কেনা হয় না। তবে শুধু অবক্ষয় নয়, মানুষের রুচির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান। আধুনিক আসবারের দোকান থেকে বিগবাজার, কিং‌বা কাপের্টের দোকান থেকে বাংলাদেশের ঢাকাই শাড়ি, নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস থেকে জিভে জল আনা হাজারো খাবারের দোকান— সব কিছুই হাজির এখানে।

তাই, আজও তপ্ত দিনের শেষে, চৈত্র শেষের সন্ধ্যায় অগুনতি মানুষের ঢল নামে এই মেলায়। কেউ আসেন দেব-দর্শনে, কেউ বা নববর্ষের কেনাকাটা করতে। কেউ বা নিছক মেলার মেজাজ উপভোগ করতে। ক্লান্ত দিনের শেষে হাজারো মানুষের কোলাহলের মাঝে রাজবাড়ির তোরণের আড়ালে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভায় ধবনিত হয় বাংলার বিক্রমাদিত্যের কত না অজানা কীর্তি। সেই রাজাও নেই, রানিও নেই। শুধু ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে টিকে আছে বারোদোলের মেলা।

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন