আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার পরে লক্ষ্মণ শেঠ। লোকসভা ভোটের আগে এক মাসের মধ্যে দু’জন ডাকসাইটে নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করল সিপিএম!
প্রবীণ বিধায়ক রেজ্জাকের মতোই তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণবাবুকেও জনসমক্ষে দলের ভাবমূর্তি হেয় করার দায়ে বহিষ্কার করা হল। সিপিএমের গঠনতন্ত্রের যে ১৯ নম্বর ধারার ১৩ নম্বর উপধারা কাজে লাগিয়ে লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ নেই। রেজ্জাককেও এই ধারায় চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। দলের সিদ্ধান্ত জেনে লক্ষ্মণবাবু অবশ্য বলেছেন, “আমি আগেই বলেছি, পার্টির সদস্যপদ নবীকরণ করাতে চাই না। আমিই যখন পার্টি ছেড়ে দিয়েছি, তার পরে আর বহিষ্কারের মানে কী? মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা দিয়ে কী লাভ?”
তবে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্য, দল-বিরোধী কাজের দায়ে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের মধ্যে সকলের জন্যই একটি বার্তা আছে। বিশৃঙ্খলা এবং প্রকাশ্যে দল-বিরোধী বিবৃতি যে বরদাস্ত করা হবে না, রেজ্জাকের পরে লক্ষ্মণকে বহিষ্কার করে তা-ই বুঝিয়ে দেওয়া হল। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “কেউই যে দলীয় শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে নন, সাধারণ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠদের কাছে সেই বার্তা দিতেই তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।” লক্ষ্মণবাবুর বদলে তমলুকে এ বার সিপিএম প্রার্থী করেছে ছাত্র-নেতা শেখ ইব্রাহিম আলিকে। লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কারের জেরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সংগঠনে কিছু প্রভাব পড়লেও জনসমক্ষে দলের ভাবমূর্তির পক্ষে দীর্ঘ মেয়াদে এই সিদ্ধান্তের ফলে লাভ হবেই বলে আলিমুদ্দিন মনে করছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে বৃহস্পতিবার রাতে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পূর্ব মেদিনীপুরে পার্টি সংগঠনকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে রাজ্য কমিটি যখন সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে, সে সময় গুরুতর পার্টি-বিরোধী কার্যকলাপ ও পার্টির ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে হেয় করার কাজে লিপ্ত হয়েছেন ওই জেলার জেলা কমিটি ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য লক্ষ্মণ শেঠ। এই অভিযোগে তাঁকে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তক্রমে পার্টি গঠনতন্ত্রের ১৯ নং ধারার ১৩ নং উপধারায় পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে’।
বস্তুত, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্যের বয়ে নিয়ে আসা সদস্যপদের ফর্ম পূরণ না-করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশস্তি গেয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার পরেই লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কারের ব্যাপারে মনস্থ করে ফেলেছিল আলিমুদ্দিন। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এখন উত্তরবঙ্গে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এ দিন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেই সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেন রাজ্য নেতারা। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে এ দিন ময়নাগুড়িতে লক্ষ্মণ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বিমানবাবু বলেন, “ব্যক্তি যখন নিজেকে দলের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে, তখন দলকে অনেক ছোট মনে হয়। ওই সময় ব্যক্তি অনেক বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে থাকে। এ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।” লক্ষ্মণবাবু কি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই? বিমানবাবু বলেন, “তলে তলে কে কী করছে, বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে দেখব। এর বেশি একটি কথাও বলব না।” রাতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে প্রাক্তন সাংসদ অবশ্য জানিয়েছেন, সিপিএম তাঁকে ছেঁটে ফেললেও এখন তিনি অন্য কোনও দলে যোগ দিচ্ছেন না।
দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে এখন পূর্ব মেদিনীপুরের দায়িত্বে রবীন দেব। জেলার পরিস্থিতি সম্পর্কে রাজ্য নেতৃত্বকে ঠিক রিপোর্ট না-দিয়ে রবীনবাবু জটিলতা বাড়িয়েছেন বলে বারবার নালিশ করেছেন লক্ষ্মণবাবু। তমলুকে দলীয় কর্মিসভায় গিয়ে রবীনবাবু এ দিনই বলেছেন, “এর আগেও দলীয় নেতৃত্বকে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করেছিলেন লক্ষ্মণ শেঠ। এখন তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন, তাতে পার্টির এত বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণবাবুর মতো এক জন পোড় খাওয়া নেতার কাছ থেকে এ সব মন্তব্য শুনতে হচ্ছে! এটা পরিতাপের বিষয়।” পূর্ব মেদিনীপুরের লক্ষ্মণ-বিহীন সংগঠনকে চাঙ্গা করার গুরুদায়িত্ব এখন অনেকটা পালন করতে হবে রবীনবাবুকেই।
উদ্ভুত পরিস্থিতি বিপাকে ফেলেছে একদা লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠদেরও। লক্ষ্মণ-শিবিরের অন্যতম নেতা বলে পরিচিত জেলা সম্পাদক কানু সাহুও তোপ দেগেছেন তাঁর একদা ছাত্রের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, “দল-বিরোধী কাজের জন্যই লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কার করা হল। উনি সদস্যপদ নবীকরণ না-ই করাতে পারতেন। কিন্তু লোকসভার ভোটের মুখে যে সব মন্তব্য করেছেন, সেটা অন্যায় হয়েছে।” বহিষ্কার প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান। তবে তমলুকের প্রার্থী ইব্রাহিম দাবি করেছেন, দীর্ঘদিন লক্ষ্মণবাবু জেলায় নেই। তাই ভোটে এই বহিষ্কার প্রভাব ফেলবে না। ইব্রাহিমের মন্তব্য, “উনি তো নিজেই তৃণমূল সরকারের আমলে মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে জেলে ছিলেন। এর পরেও মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করছেন!” বহিষ্কারের পরে লক্ষ্মণবাবু ‘প্রাক্তন’ দলের বিরুদ্ধে মুখ খোলা অব্যাহত রাখবেন বলে আলিমুদ্দিন ধরেই নিয়েছে। পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “সিপিএম থেকে কাউকে বহিষ্কারের পরে সেই নেতা দলের সমালোচনা করলে সংবাদমাধ্যম কয়েক দিন গুরুত্ব দেয়। তার পরে আর তাঁর কথার কোনও গুরুত্ব থাকে না।” সাম্প্রতিক কালে অনিল বসু, রেজ্জাকের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা আলিমুদ্দিনের।