সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র এবং প্রভাবশালীদের ভূমিকা খতিয়ে দেখবে সিবিআই। তদন্তে নামার ৮৫ দিনের মাথায় সারদা মামলার প্রথম চার্জশিটে অবশ্য প্রভাবশালীদের নাম দেখা গেল না।
বুধবার কলকাতার নগর দায়রা আদালতে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস সংক্রান্ত একটি মামলার চার্জশিট পেশ করলো সিবিআই। তাতে অভিযুক্ত হিসেবে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন, সারদার অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং সারদার গ্রুপ মিডিয়া সিইও কুণাল ঘোষের নাম রয়েছে। সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা অবশ্য জানিয়েছেন, সারদা কেলেঙ্কারির আরও তিনটি মামলা তাঁদের হাতে রয়েছে। এটা প্রথম মামলায় প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে দেওয়া চার্জশিট। পরবর্তী পর্যায়ে প্রভাবশালীদের নাম চার্জশিটে আসতে পারে বলে সিবিআই সূত্রের বক্তব্য।
সারদা তদন্তে প্রথমে রাজ্য সরকারের তরফে শ্যামল সেন কমিশন এবং রাজ্য পুলিশের সিট গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। সেই মামলাতেই চলতি বছরের ৯ মে সারদা-সহ ৪৪টি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের পক্ষে রায় দেয় শীর্ষ আদালত।
এ দিন সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর চার্জশিটে সারদার আরও তিনটি সংস্থার নাম রেখেছে সিবিআই। এই তিনটি সংস্থা হল: সারদা রিয়েলটি, সারদা হাউজিং এবং সারদা গার্ডেন হোটেলস অ্যান্ড রিসর্টস। চার্জশিটে নাম রয়েছে কুণাল ঘোষের সংস্থা স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া সংস্থারও। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই প্রাইজ, চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন স্কিমস (ব্যানড) আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ধারায় চার্জ দিয়েছে সিবিআই। সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা বলছেন, সারদার অন্যতম শীর্ষপদে (গ্রুপ মিডিয়া সিইও) ছিলেন কুণাল। সেই সূত্রেই তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারিতে তাঁর সংস্থার নাম এসেছে অন্য কারণে।
কী সেই কারণ?
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, কুণাল ঘোষের এই সংস্থা একটি বাংলা সিনেমা প্রযোজনা করেছিল। তাতে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর কয়েক কোটি টাকা ঢালা হয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের দাবি। সেই সূত্রেই স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া সংস্থাকে চার্জশিটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সারদা গোষ্ঠীর ভ্রমণ সংস্থা সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? তদন্তকারীদের ব্যাখ্যা, এই সংস্থা প্রতি মাসে কিস্তিতে টাকা জমা নিত। তার বিনিময়ে বছর শেষে আমানতকারীদের কোনও ভ্রমণ প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত। কিন্তু বেশির ভাগ আমানতকারীই ভ্রমণ করতে পারেননি বলে অভিযোগ। সিবিআইয়ের দাবি, আমানতকারীদের থেকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা তোলা হয়। তার মধ্যে ৯৮৮ কোটি টাকাই ফেরত দেওয়া হয়নি। প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা তোলা এবং প্রতারণার অভিযোগেই সুদীপ্তদের প্রাইজ, চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সিবিআই সূত্রের খবর, এই সংস্থার সঙ্গেই চুক্তি হয়েছিল রেলের সংস্থা আইআরসিটিসি-র। নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই এই চুক্তি হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। তবে তদন্তের কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি সিবিআই। তাই এ ক্ষেত্রে পরে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করা হতে পারে।
সারদা রিয়েলটি, সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, সারদা কন্সট্রাকশন-সহ একাধিক সংস্থার বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা মামলা দায়ের করেছে সিবিআই। তদন্তে নেমে গ্রেফতার করা হয়েছে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু এবং ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবালকে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী, রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন, সিপিএম নেতা রবীন দেব, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান, প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী, রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক রেজাউল করিম-সহ বেশ কয়েক জন প্রভাবশালীকে। সিবিআই সূত্রের খবর, নানা লোককে জিজ্ঞাসাবাদের পরে মোটামুটি ভাবে তদন্তের একটি গতিপ্রকৃতি ঠিক করেছেন তদন্তকারীরা। তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরুর ৮৫ দিনের মাথায় প্রথম চার্জশিট পেশ করলেন তাঁরা।
সিবিআইয়ের পাশাপাশি সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে আরও একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা, ইডি। কিছু দিনের মধ্যে তারাও চার্জশিট জমা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে বলে ইডি সূত্রের খবর।