চোরাশিকারিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গন্ডারদের খড়্গ কেটে দেওয়া হয়েছে, (ইনসেটে, প্রতিবেদক)। ছবি: প্রতিবেদক
আর দিন কয়েক বাকি। ডিসকভারি চ্যানেলে বেয়ার গ্রিলসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সাফারি’ দেখার জন্য আপনাদের অনেকেই নিশ্চয় মুখিয়ে রয়েছেন। মোদীর সাফারি-সঙ্গীর শিষ্য কিন্তু আমিও। তাঁর অ্যাকাডেমির কল্যাণে জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-বনে প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছি।
‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ খ্যাত বেয়ার ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কম্যান্ডো ইউনিটের অফিসার। ইংল্যান্ডে তাঁর ‘সারভাইভাল অ্যাকাডেমি’ রয়েছে। সেখানে দুর্গম অঞ্চলে বেঁচে থাকার কৌশল শেখান বেয়ারের পরিচিত ‘রয়্যাল মেরিন কম্যান্ডো’রা। কলকাতায় এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই যেতাম ট্রেকিংয়ে। বিলেতেও সেই অভ্যাস বজায় রেখেছি। তেমনই একটা অভিযান থেকে ফেরার পথে ‘ফ্লাইট ম্যাগাজ়িনে’ পড়েছিলাম বেয়ারের অ্যাকাডেমির কথা। তারপর বেশ কয়েকটা কোর্সও করেছিলাম। তারই একটির কথা বলি।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে গিয়েছিলাম জিম্বাবোয়েতে। অন্যতম বিমানবন্দর ভিক্টোরিয়া ফলস। উনিশ শতকের বিখ্যাত ভূপর্যটক ডেভিড লিভিংস্টোন আবিষ্কার করেন বিশ্বের গভীরতম এই জলপ্রপাত— ভিক্টোরিয়া ফলস। একশো বছর আগে এই জিম্বাবোয়েরই নাম ছিল রোডেশিয়া— চাঁদের পাহাড়ের সেই দেশ যেখানে পাড়ি দিয়েছিল শঙ্কর এবং দিয়েগো আল্ভারেজ। বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলাম নাকাবাঙ্গো। জঙ্গলের মধ্যে ফরেস্ট রেঞ্জারদের অফিস আর গেস্ট হাউস। সেখান থেকে বিস্তীর্ণ এলাকার জীবজন্তুর ওপর নজর রাখা হয়। বিশ্বের বাকি অংশ থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা আসেন বন্যপ্রাণীদের রক্ষায় সাহায্য করতে। এমনকি, অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নেন চোরাশিকারিদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য।
নাকাবাঙ্গোতে পৌঁছে পরিচয় হল দলের অন্যদের সঙ্গে। কানাডা থেকে এসেছে ক্যাম— মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সুইৎজ়ারল্যান্ড থেকে লুকা— আগে ছিলেন মিলিটারি অফিসার। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে খনি-বিশেষজ্ঞ জিয়ান, স্পেন থেকে ফ্যাশন ডিজাইনার হেলেন এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জেমস, জিম্বাবোয়ের ওয়াইল্ড-লাইফ গাইড রিচার্ড। আমাদের প্রশিক্ষক নাইজেল— জিম্বাবোয়েরই, ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে ছিলেন আর অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বিশেষজ্ঞ পল, স্থানীয় সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান ডিন।
দক্ষিণ গোলার্ধে তখন শীতকাল। অন্ধকার নামার পর থেকে জাঁকিয়ে শীত। উঁচু-নিচু রাস্তায় লাফাতে লাফাতে সাভানা চিরে ছুটে চলল আমাদের রোভার। প্রায় ঘণ্টা দুই পরে থামল জঙ্গলে। খাটানো হল ছোট ছোট তাঁবু। আগুনের চারপাশে বসে স্থানীয় বাজরার আটা জলে গুলে, সেদ্ধ করে সাঙ্গ হল রাতের খাবার। বলে রাখা দরকার, আমাদের সঙ্গে ছিল স্লিপিং-ব্যাগ, ম্যাট্রেস, জলের বোতল, শিকারের ছুরি। ক্যাম্পের পাশে কিছুটা নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মাসুই নদী— কুমিরে ভরা। আমরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের গাছ থেকে শুরু হয়েছিল বেবুনদের চিৎকার। অনেকে পালালও। পরে অবশ্য সন্ধে হতেই তারা অন্য প্রাণীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের কাছের গাছগুলোতেই হুড়োহুড়ি করে এসে উঠত।
পরদিন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। জঙ্গলে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে প্রাতঃকৃত্য। এর পর গা গরম করার জন্য মার্শাল আর্টের অনুশীলন। সে দিন জঙ্গলে গিয়ে চিনলাম গাছপালা এবং স্থানীয় ভূপ্রকৃতি। এক জায়গায় গাছের বাকল ফালা ফালা— বুনো হাতির কাজ। জঙ্গলে এবং মাসুই নদীর বাঁধের ধারে নানা জন্তুর পায়ের ছাপ, বুনো হাতির মল। শুকনো মলের মধ্যে পাওয়া গেল এক ধরনের বাদাম। এই বাদামের গাছগুলো জন্মায় দূরে, পার্বত্য অঞ্চলে। বুনো হাতি এই ফল খেয়ে বহু মাইল হেঁটে মাসুই নদীতে আসে জল খেতে। এই ধরনের কিছু বাদাম জোগাড় করে পাথর দিয়ে ভেঙে খাওয়া হল ভিতরের শাঁস। তারপর দু’টি গাছের মধ্যে দড়ি বেঁধে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার অনুশীলন, কাঁটা গাছের ঝোপ কেটে আশ্রয়স্থল তৈরি। বলে রাখি, রাইফেল হাতে চারপাশে সারাক্ষণই নজর রাখছিলেন দু’জন রেঞ্জার।
সন্ধের আগে আমরা বেরোলাম ক্যাম্পের চারপাশে ঘুরে আসতে। নিঃশব্দে চলেছি। হঠাৎ ডিন হাত তুলে থামতে বললেন। নড়ে উঠল বাঁ দিকের জঙ্গল। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন বিশালকায় গজরাজ। দুদ্দাড় করে পিছিয়ে এলাম বেশ কিছুটা। ডিনের হাতের রাইফেল উদ্যত। দু’পক্ষই পরস্পরকে মাপছে নিঃশব্দে। কত ক্ষণ কেটে গেল, হিসেব নেই। অবশেষে সম্রাট ধীরে ধীরে আমাদের ডান দিকের জঙ্গলে চলে গেলেন। ক্যাম্পে ফিরে যবের আটা জলে সেদ্ধ করে, আর আনাজ সেদ্ধ খেয়ে নৈশভোজ। সারাদিনের শ্রান্তি, অথচ ঘুম আসছে না। গাছে বেবুনদের ডাকাডাকি, বুনো হাতির জঙ্গল ভাঙার আওয়াজ।
ভোর রাতের তন্দ্রা ভেঙে গেল অন্য গর্জনে— ক্যাম্পের খুব কাছ থেকে ডাকছে সিংহ। প্রথমে একটি, পরে দু’টি ক্যাম্পের দু’দিক থেকে। তাঁবুর ভেতরে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাকি সময়টা পার করলাম।
প্রস্তুত হলাম পরবর্তী যাত্রার জন্য। রুকস্যাক গুছিয়ে ল্যান্ডরোভারে বসলাম। সাভানা ভেদ করে এগিয়ে চলল আমাদের রোভার। এক জায়গায় দেখা হল তিনটি গন্ডারের সাথে— মা আর প্রমাণ সাইজের দু’টি সন্তান। চোরাশিকারিদের থেকে রক্ষা করতে তাদের খড়্গ কেটে দেওয়া হয়েছে। আমাদের রোভারের গায়ে গা চুলকে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল তারা।
এ বার গন্তব্য জাম্বেজি নদী, যা অতিক্রম করে হিরের খনির সন্ধানে গিয়েছিল শঙ্কর এবং আল্ভারেজ...।