সকাল সাতটায় ব্রাসেলস-এ নেমে সবে লাউঞ্জে বসেছি। আমি আর মা (সুমতি)। তিন ঘণ্টা পরে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট। মা পাশে বসে বাবাকে ফোন করল। আমরা উড়ানে দূরে কোথাও গেলে বাবা সারা রাত জেগে থাকে। পৌঁছে ফোন করলে তবে নিশ্চিন্ত হয়। আমার বাবা, মানে গায়ক অভিজিৎ।
বাবা ফোনে বলল, একটু কিছু খেয়ে নিতে। আমি আর মা খাব-খাব ভাবছি, দেখি সবাই হঠাৎ ছুটতে শুরু করেছে। কেন? আমরা ঘাবড়ে গিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। এক জন দৌড়তে দৌড়তে চিৎকার করে বলে গেলেন, ‘দাঁড়িয়ে থাকবেন না, ছুটুন।’ টার্মিনাল দিয়ে তখন কয়েকশো মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। আমরাও পা মেলালাম। এক জন বললেন, ‘বোমা ফেটেছে! বিমানবন্দরের ভিতরে।’
রক্তাক্ত। বিস্ফোরণের পরে, জাভেন্তেম বিমানবন্দরে। মঙ্গলবার পিটিআইয়ের ছবি।
শুনে গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে। খালি মনে হচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে কানের পাশে বিকট শব্দ হবে। মানুষ এদিক-ওদিক ছিটকে পড়বে। পথ যেন আর শেষই হতে চায় না। টার্মিনালের শেষ প্রান্তে এসে সবাই থমকে গেলাম। এ বার কোথায় যাব? সিকিউরিটি অফিসারেরা এসে বললেন, ‘ভয় নেই। আপনারা নিরাপদে আছেন।’
মা এর মাঝে আরও কয়েক বার বাবাকে ফোন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফোন পাওয়া যাচ্ছিল না। মা ভয়ে কেঁদে ফেলছিল। একটু পরে বাবাই ফোন করল। বলল, ‘টার্মিনাল থেকে বেরোবে না।’ কিন্তু ওরা তো টার্মিনালে থাকতে দিল না। সকলকে টারম্যাকে নিয়ে গেল। খোলা আকাশের নীচে। প্রচণ্ড ঠান্ডা। মায়ের সঙ্গে একটা শাল। আমার গায়ে খুব পাতলা একটা জ্যাকেট। সঙ্গে যে হ্যান্ডব্যাগ ছিল, রেখে আসতে হয়েছে টার্মিনালে।
নিউ ইয়র্কে ফিল্ম নিয়ে একটা কোর্স করতে যাচ্ছিলাম। সোমবার রাতে জেট এয়ারওয়েজের বিমান ধরেছিলাম মুম্বই থেকে। ব্রাসেলস হয়ে নিউ ইয়র্ক। ঠিক ছিল, বাবা দু’দিন পরে নিউ ইর্য়ক আসবে। আমাদের সঙ্গে দু’দিন থেকে বাবার যাওয়ার কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখানে বাবার অনুষ্ঠান রয়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা টারম্যাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল এয়ারপোর্ট-লাগোয়া একটা স্কুলে। ঠান্ডা হাওয়া থেকে একটু বাঁচলাম। সকাল থেকে কিছু খাইনি। স্কুলবাড়িতে আমাদের একটু খাবার আর কোল্ড ড্রিঙ্ক দেওয়া হল। কত ক্ষণ এ ভাবে কেটেছে বলতে পারব না। মোবাইলের চার্জ শেষ। স্কুলবাড়িতে চার্জ দিয়ে বাবাকে হোয়্যাটসঅ্যাপ করল মা। খানিক পরে অন্য একটা শহরের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। স্থানীয় ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে। সঙ্গে কোনও ব্যাগ নেই। মালপত্র নেই। যে জামাকাপড় পরে সোমবার রাতে ফ্লাইট ধরেছি, সেই জামাকাপড় পরেই আছি। কবে ব্যাগ, মালপত্র ফেরত পাব জানি না। বাইরে থেকে জামাকাপড় কিনে আনারও উপায় নেই। কড়া নির্দেশ, হোটেল থেকে বেরোনো যাবে না। কত ক্ষণ এ ভাবে থাকতে
হবে, কবে নিউ ইয়র্ক যেতে পারব, আদৌ যেতে পারব কি না, দেশে ফিরে যেতে হবে কি না— কিচ্ছু জানি না।