গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পর পর বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলেছে ভারত। নীরবে সেরে ফেলা হয়েছে বাহিনীর কিছু জরুরি আধুনিকীকরণও। পাকিস্তানের অস্বস্তি বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক ছিল। পাক প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গেল, শুধু অস্বস্তিতে নয়, নয়াদিল্লির গতিবিধিতে আতঙ্কে রয়েছে ইসলামাবাদ। ভারতের ‘আক্রমণাত্মক আচরণ’ দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে বলে মন্তব্য করেছেন পাক প্রেসিডেন্ট। কিছু দেশ ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে বলেও প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির দাবি।
সোমবার ইসলামাবাদে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধ সংক্রান্ত বিষয়ে সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আলফি সেই সম্মেলনে সরাসরি নাম করে আক্রমণ করেন ভারতকে। তিনি বলেন, ‘‘ভারত যে রকম আক্রমণাত্মক আচরণ করছে এবং যে ভাবে (বাহিনীতে) নানা মারণাস্ত্রের অন্তর্ভূক্তি ঘটাচ্ছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়ে পড়ছে।’’
সামরিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু দেশ ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন পাক প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতকে পরমাণু প্রযুক্তি এবং আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য কিছু দেশ যে পক্ষপাতমূলক ছাড় দিয়েছে, তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিধির বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করেছে।’’ কোন কোন দেশ ভারতকে ‘পক্ষপাতমূলক ছাড়’ দিচ্ছে, তা পাক প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেননি ঠিকই। কিন্তু আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশগুলির দিকেই যে পাক প্রেসিডেন্ট আঙুল তুলতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট।
আরও পড়ুন: রাফাল: অম্বানীর সংস্থাকে মানতে ‘বাধ্য’ হয়েছিল দাসো, জানাল নথিপত্র
ন্যাটোর বাইরে যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমেরিকার সর্বোচ্চ সামরিক সমঝোতা রয়েছে, ভারত সেগুলির অন্যতম। ভারত মহাসাগরীয় এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত ও আমেরিকার নৌসেনা পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় রেখে কাজ শুরু করেছে।
ফ্রান্সের সঙ্গে রাফাল চুক্তি চূড়ান্ত করেছে ভারত। পৃথিবীর সেরা যুদ্ধবিমানগুলির অন্যতম রাফালকে আবার ভারতের কিছু বিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে বিশেষ ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকেই একে একে ভারতের হাতে আসতে শুরু করবে রাফাল যুদ্ধবিমানগুলি। রাফালের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে এলে যে চিন-পাকিস্তানের যৌথ শক্তির মোকাবিলার প্রশ্নেও ভারত অনেকটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে চলে আসবে, তা সামরিক কর্তারাই বলছেন।
সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সমঝোতা হয়ে গেল ভারতের। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফর করলেন চলতি মাসেই। তখনই ভারত-রাশিয়ার মধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ চুক্তি। ওই অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম দেশের আকাশসীমার নিরাপত্তা আরও জোরদার করবে, রুখে দেবে ক্ষেপণাস্ত্র হানা। রাশিয়ার কাছ থেকে নৌসেনার জন্য বেশ কিছু স্টেল্থ ফ্রিগেটও কিনছে ভারত। কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। অত্যাধুনিক ওই সব রণতরী থেকে ব্রহ্মসের মতো শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া যাবে।
আরও পড়ুন: কম মানসিক চাপের শহরের তালিকায় শীর্ষে স্টুটগার্ট, কলকাতা কত নম্বরে জানেন?
এই সব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির বাইরেও ভারত সেরে ফেলেছে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানগুলির আধুনিকীকরণের কাজও। প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের ফলে মিগ-২৯ ফাইটারগুলি এখন আগের চেয়েও ক্ষিপ্র বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর। মিগ-২৯ যুদ্ধিবিমানগুলির আধুনিকীকরণের কাজ যে চলছিল, তা কিন্তু যথা সম্ভব গোপনই রেখেছিল ভারত। কাজ শেষ হওয়ার পরে জানানো হয়েছে যে, মিগ-২৯ এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি সক্ষম।
সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি এবং বৃহৎ সামরিক শক্তিগুলিকে পাশে পাওয়ার এই কাজ কিন্তু আচমকা হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরেই অল্প অল্প করে এগোচ্ছিল ভারত। গত কয়েক বছরে পর পর অনেকগুলো পরিকল্পনার রূপায়ণও ঘটে গিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান অনেকটা পিছনে রয়ে গিয়েছে তাদের বাহিনীর আধুনিকীকরণের প্রশ্নে। সেই কারণেই ইসলামাবাদ আতঙ্কিত বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ভারতের এই ‘একতরফা’ শক্তিবৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক মহল মদত জোগানোয় দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য টলে যাচ্ছে বলে ইসলামাবাদ বার বার দাবি করতে শুরু করেছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সবই হল সহানুভূতি আদায়ের পাকিস্তানি কৌশল।
পাক সেনার মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর কয়েক দিন আগেই বলেছেন, ভারত একবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করলে পাকিস্তান দশ বার করবে। কিন্তু পাকিস্তানের এই সব হুমকিকে ভারত ‘ফাঁকা আওয়াজ’ ছাড়া অন্য কিছুই ভাবে না এখন, বলছেন ভারতীয় সেনার বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্তা।
ভারতকে বার বার হুমকি দিলে যে ভারতের লাভই হবে, আন্তর্জাতিক মহলকে যে ভারত আরও কাছে টানতে সক্ষম হবে, তা পাক বিশেষজ্ঞরাও বোঝেন। তাই পাক প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি এ বার আরও জোর দিয়ে ভারতের ‘একতরফা শক্তিবৃদ্ধি’র তত্ত্ব খাড়া করতে চাইলেন বলে ওয়াকিবহাল মহলের মত।