Israel-Iran Conflict

কেন ইরানে হানা ইজ়রায়েলের? প্রত্যাঘাত হতে পারে কী ভাবে? পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি কিন্তু চাপেও রেখে দেবে ট্রাম্পকে

যে পরমাণু চুক্তি সইয়ের জন্য এখন ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে প্রথম মেয়াদে ইরানের সঙ্গে সেই ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ বাতিল করেছিলেন তিনিই!

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫ ০৮:৫৬
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

রাষ্ট্রপুঞ্জ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি অভিযোগ তুলেছিলেন বৃহস্পতিবার। আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ভেঙে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে বলে তাঁর সংস্থার গভর্নর বোর্ডের রিপোর্টে জানানো হয়েছিল। আর তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরানের বিভিন্ন পরমাণুকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাল ইজ়রায়েলি বিমানবহর।

Advertisement

ইরানের নজরদারি এড়িয়ে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ তছনছ করে দিয়েছে ইরানের অন্তত ছ’টি পরমাণু ও সামরিক কেন্দ্র। দুশোর বেশি বোমারু ও যুদ্ধবিমানের হানায় ইরান সেনার একাধিক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ইরানের পরমাণু পরিকাঠামোর আদৌ কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, অতীতেও ইজ়রায়েল হামলা চালিয়েছে তেহরানের পরমাণুকেন্দ্রে। কিন্তু তাতে ইউরেনিয়াম পরিশোধনের কাজ তেমন ব্যাহত হয়নি।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সামরিক বিশ্লেষক সেড্রিক লেইটন শুক্রবার জানিয়েছেন, ইরান তাদের ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্রগুলির সুরক্ষাকবচ হিসেবে যে বিশেষ ধরনের কংক্রিট ব্যবহার করে, তা কার্যত দুর্ভেদ্য। ওয়াশিংটনের কুইন্সি ইনস্টিটিউটের শীর্ষ আধিকারিক ত্রিতা পার্সির মতে, ভূপৃষ্ঠের ৫০০ মিটারেরও বেশি গভীরে তৈরি করা ওই কংক্রিটের বহুস্তরীয় সুরক্ষাকবচ পরমাণু হামলা ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব নয়।

Advertisement

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত ইরান পরমাণু চুক্তি সই করতে রাজি হবে না বলে বুধবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ঘটনাচক্রে, আগামী রবিবারই পরমাণু চুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটন-তেহরান ষষ্ঠ দফার বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তার ৭২ ঘণ্টা আগে হামলা চালিয়ে তেল আভিভ পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলল বলেই মনে করছেন অনেকে। ট্রাম্প অবশ্য শুক্রবার ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই এবং প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েকশিয়ানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। পরমাণু চুক্তি সই করে ইউরেনিয়াম পরিশোধন কর্মসূচি বন্ধ না করলে আরও ভয়ঙ্কর হামলার মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে সেই সঙ্গেই তিনি কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, ইরান এখনও পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারেনি। বস্তুত, একই কথা বলা হয়েছে আইএইএর রিপোর্টেও।

সাধারণ ভাবে পরমাণু বোমা তৈরি করতে গেলে ৯০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন। এখনও তেহরান সেই দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি বলেই আইএইএ-র পর্যবেক্ষকদের মত। তবে ৪২ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে কম ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু বোমা বানানো সম্ভব। কিন্তু তা থেকে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইরান প্রায় ২৭৫ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরির কাজে সফল হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরের আইএইএ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তেহরানের হাতে সাড়ে ৯২ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। তা ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, পরমাণু সেন্ট্রিফিউজ় (যা অস্ত্র নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে) তৈরির কাজেও সাফল্য পেয়েছে ইরান।

তেহরানের তরফে অবশ্য বার বারই জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু মাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে এ সব যুক্তিতে ‘চিঁড়ে ভেজেনি’। এই আবহে ইজ়রায়েলি হামলার পরে শুক্রবার পেজ়েকশিয়ান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘‘এই কাহিনির শেষ অধ্যায়টা কিন্তু আমরাই লিখব।’’ ইরানের ‘ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত কোম শহরের জ়ামকারান মসজিদের চূড়ায় জুম্মার নমাজের পর লাল পতাকা তুলে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম এশিয়ায় মোতায়েন মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলির নিরাপত্তা নিয়ে যে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন, মার্কোর শুক্রবারের বক্তৃতাতেও তা স্পষ্ট। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বুধবার পরমাণু চুক্তি নিয়ে আমেরিকাকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদে বলেছিলেন, ‘‘পশ্চিম এশিয়ার সবগুলি মার্কিন সেনাঘাঁটি কিন্তু আমাদের নাগালে রয়েছে।’’

যে পরমাণু চুক্তি সইয়ের জন্য এখন ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, ঘটনাচক্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে প্রথম মেয়াদে ইরানের সঙ্গে সেই চুক্তি বাতিল করেছিলেন তিনি স্বয়ং! ২০১৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জমানায় ইরানের সঙ্গে তিন বছরের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করেছিল ছয় শক্তিধর রাষ্ট্র— ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, চিন এবং আমেরিকা। চুক্তির নাম ছিল ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ)। তাতে স্থির হয়, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধ রাখলে তেহরানের উপর বসানো আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ, আমেরিকা এবং অন্য কয়েকটি দেশ। সব পক্ষই তা মেনে নিয়েছিল। অথচ ২০১৮-য় একতরফা ভাবে সেই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন ট্রাম্প। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই পরমাণু চুক্তি ওবামার ভুল পদক্ষেপ। এর ফলে আমেরিকার কোনও সুবিধা হয়নি। উল্টে লাভ হয়েছে ইরানের।’’

এর পর গত বছরের শেষে আইএইএ-র একটি রিপোর্টে বলা হয়, ফের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করেছে ইরান। তাদের কাছে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। এর পরেই নড়েচড়ে বসে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি নিরাপত্তা পরিষদে খোলা চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, প্রয়োজনে ইরানের পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হয়ে ওঠা আটকাতে তারা সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত। আর ট্রাম্প? মার্চের গোড়ায় খামেনেইকে চিঠি পাঠিয়ে বৈঠকে বসে পরমাণু চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য দু’মাসের ‘চরম সময়সীমা’ বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিম এশিয়ার সাম্প্রতিক অশান্তির জন্য ট্রাম্পের এই ঘোষণা ‘অন্যতম অনুঘটক’ বলে কূটনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা।

এর আগে ২০২৪ সালে ইরান ও ইজ়রায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। গত ২ অক্টোবর ইজ়রায়েলের কয়েকটি শহরে অন্তত ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল ইরান। কিন্তু সংঘাতের অভিঘাত এ বার অনেকটাই প্রবল। সামরিক শক্তির নিরিখে অবশ্য শিয়া মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে ইহুদি ইজ়রায়েল। তা ছাড়া গত দু’বছরে উপসাগরীয় অঞ্চলে তেল আভিভের বিরুদ্ধে তেহরানের ‘যৌথ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি’ (সামরিক পরিভাষায় ‘অ্যাক্সিস অফ রেজ়িস্ট্যান্স’) অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। গাজ়া ভূখণ্ডে ধারাবাহিক হামাস এবং একের পর এক নেতার মৃত্যুর জেরে প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা ইজ়রায়েলি সেনার আগ্রাসনে কোণঠাসা হয়ে সমঝোতার পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। আমেরিকা, ইজরায়েল, সৌদি আরবের যুগপৎ হামলায় একই হাল তেহরানের আর এক সহযোগী, ইয়েমেনের শিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথির।

তবে ইরান সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে গত ডিসেম্বরে। পড়শি দেশ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে শিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের রাশিয়ায় পলায়ন এবং তুরস্কের মদতপুষ্ট সুন্নি কট্টরপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর। গত সাড়ে তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় ইরানের দীর্ঘ দিনের সামরিক সহযোগী রাশিয়াও এ বার কতটা সহায়তা করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই আবহে পড়শি দেশ জর্ডন বৃহস্পতিবার ইরানের উপর হামলা চালাতে ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমানকে আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেওয়ায় চাপ বেড়েছে খামেনেই-পেজ়েকশিয়ানদের উপর।

হামলায় প্রতিশোধ নিতে শুক্রবার শতাধিক ড্রোনের বহর ইজ়রায়েলে পাঠিয়েছিল ইরান। কিন্তু তেল আভিভের ‘আয়রন ডোম’ সফল ভাবে তা প্রতিহত করেছে। তবে শুক্রবার রাতে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইজ়রায়েলের তেল আভিভে সফল হামলা চালিয়েছে ইরান ফৌজের এলিট ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড অ্যাকোস্পেস ফোর্স’। ইজ়রায়েল সেনার ‘আয়রন ডোম’ এবং মার্কিন ‘থাড’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে এই হানাদারি তেহরানের ‘চমকপ্রদ সাফল্য’ বলে সামরিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন। যদিও পুরোপুরি যুদ্ধ বাধলে নিশ্চিত ভাবেই ‘ব্যাকফুটে’ তেহরান। বস্তুত, ইজ়রায়েলের এই যুদ্ধস্পৃহার ক্ষেত্রে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অজুহাত মাত্র বলেও অভিযোগ উঠেছে। অনেকে মনে করছেন, সামরিক শক্তিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ইজ়রায়েলের আসল লক্ষ্য হল, ইরানে ‘খামেনেই রাজের’ পতন ঘটানো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement