ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। —ফাইল চিত্র।
গোপন বাঙ্কারে বসেই নিজের উত্তরসূরি বাছতে শুরু করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। সম্ভাব্য তিন জনের নামও ইতিমধ্যে বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে সেই তালিকায় নেই খামেনেইয়ের পুত্র মোজতবা খামেনেইয়ের নাম! আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘর্ষের মাঝে ৮৬ বছর বয়সি খামেনেই কোনও এক গোপন বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কোথায় রয়েছেন, তা সকলের কাছ থেকে গোপনে রাখতে চাইছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। যোগাযোগের জন্য বৈদ্যুতিন কোনও মাধ্যম ব্যবহার করাও বন্ধ করেদিয়েছেন। বিশ্বস্ত এক সহচরের মাধ্যমেই বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ইরানের প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তিন সরকারি আধিকারিক এমনটাই জানিয়েছেন ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’কে।
পশ্চিম এশিয়ায় সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে ইরানের একাধিক সামরিক কর্তা নিহত হয়েছেন। তাঁদের পরিবর্তও ইতিমধ্যে বেছে নিয়েছেন খামেনেই। এ বার নিজের উত্তরসূরি হিসাবেই তিন জন শীর্ষ ধর্মীয় নেতাকে মনোনীত করে ফেললেন তিনি। সূত্রের খবর, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খামেনেই নিহত হলে ওই তিন জনের মধ্যে থেকেই কাউকে ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসাবে বেছে নেওয়া হতে পারে। অনেকের মতে, খামেনেইয়ের তিন দশকের শাসনকালে এমন অনিশ্চয়তা আগে কখনও তৈরি হয়নি।
ইরান-ইজ়রায়েলের সংঘর্ষে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সামরিক সংঘাত থামার কোনও লক্ষ্মণ নেই। পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘর্ষে আমেরিকাও জড়িয়ে পড়বে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই আবহে সব রকম পরিস্থিতির জন্য চুপিসারে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন ইরানের শীর্ষ আধিকারিকেরা। নাম গোপন রাখার শর্তে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’কে এমনটাই জানিয়েছেন ইরানের ওই সরকারি আধিকারিকেরা। কারণ, খামেনেইয়ের জরুরিকালীন পরিকল্পনার বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করার কোনও অনুমতি নেই তাঁদের।
শিয়া কট্টরপন্থী রাষ্ট্র ইরানের নেতৃত্বের অভ্যন্তরে কী চলছে, সে বিষয়ে খুব বেশি তথ্য সরকারি ভাবে প্রকাশ্যে আসে না। তবে ওই সূত্রের দাবি, খামেনেই ধরেই নিয়েছেন ইজ়রায়েল বা আমেরিকা— কোনও একটি রাষ্ট্র তাঁকে হত্যার চেষ্টা করবে। এমনটা হলে, তা একপ্রকার সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু বলেই দেখতে চাইছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। এমন একটি আশঙ্কা থেকেই আয়াতোল্লা নিজের সম্ভাব্য উত্তরসূরি বেছে নিতে উদ্যোগী হয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ধর্মীয় সংগঠন ‘অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্ট্স’-কে সেই মতো নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
ইরানের ওই সরকারি সূত্র জানিয়েছে, খামেনেই ইতিমধ্যে তিন জন ধর্মীয় নেতার নাম প্রস্তাব করেছেন। ‘অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্ট্স’কে ওই তালিকার মধ্যে থেকে দ্রুত নিজের উত্তরসূরি বেছে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। খামেনেইয়ের দ্বিতীয় পুত্র মোজতবাও ইরানের অন্যতম ধর্মীয় নেতা। ইরান ফৌজের এলিট ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড’ বাহিনীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। দাবি করা হয়, ৫৬ বছরের এই নেতার হাতেই অঘোষিত ভাবে রয়েছে ইরানের এই বাহিনীর দায়িত্ব। পাশাপাশি, বিভিন্ন শিয়া মুসলিম সংগঠনের শীর্ষ পদেও রয়েছেন তিনি। সরকার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে আয়াতোল্লার পরেই তাঁর প্রভাব। তবে ওই সরকরি সূত্রের দাবি, খামেনেই মনোনীত তিন সম্ভাব্য উত্তরসূরির তালিকায় নেই মোজতবা!
সাধারণত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খামেনেই চাইছেন দ্রুত তাঁর উত্তরসূরি বেছে নেওয়া হোক। প্রাথমিক ভাবে শোনা যাচ্ছিল, খামেনেইয়ের উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন মোজতবা। তবে ইরানের ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সূত্রের দাবি, মোজতবা ওই তালিকা নেই। কোন তিন জনের নাম খামেনেই প্রস্তাব করেছেন, তা অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
তবে খামেনেইয়ের ‘ডান হাত’ হিসাবে পরিচিত আলিরেজা আরাফির নাম ঘিরে গুঞ্জন রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েকশিয়ানের সরকারকে পরামর্শ (আদতে ‘নির্দেশ’) দানকারী ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ এবং ‘উপদেষ্টা পরিষদ’-এর ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ইরানের ‘ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসাবে পরিচিত কোম শহরের জ়ামকারান মসজিদের পরিচালনার দায়িত্বও রয়েছে তাঁর কাঁধে। ইজ়রায়েলি হামলার পরে আরাফির নির্দেশেই জ়ামকরন মসজিদের চূড়ায় লাল পতাকা উড়িয়ে জ়েরুজ়ালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বার্তা দেওয়া হয়েছিল।
চর্চায় রয়েছে আলি আসগর হেজ়াজির নামও। আয়াতোল্লার দফতরে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্ত পদক্ষেপ পর্যালোচনার দায়িত্ব হেজ়াজির কাঁধে। তিনি ইরানের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থাগুলির তত্ত্বাবধানও করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরে। পাশাপাশি মহম্মদ গোলপায়েগানির নাম ঘিরেও গুঞ্জন রয়েছে। খামেনেইয়ের দফতরের ‘চিফ অফ স্টাফ’ হিসেবে ইরান সরকারের যাবতীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ পর্যালোচনা করেন তিনি।