টহল: মসুলে নজরদারি ইরাকি সেনাদের। সোমবার। ছবি: রয়টার্স।
পথ না পেয়ে শেষে ঝাঁপ নদীতে। মসুলে কোণঠাসা হয়ে এখন এমন দশাই হয়েছে আইএস জঙ্গিদের।
রবিবার পিঠ বাঁচাতে টাইগ্রিস নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে তারা। মার্কিন জোট শক্তির সাহায্যে ইরাকি সেনা মসুলের আইএস জঙ্গিদের ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়েছে ওই নদীতীরের কাছে। ইরাকি টেলিভিশনে দাবি, জঙ্গিদের শেষ আশ্রয়টুকুও যে মুছে যেতে চলেছে, স্পষ্ট হয়ে যায় তখনই। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে আইএসের দিন শেষ— ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল রবিবারই। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দর আল-আবাদি আইএসের প্রাক্তন ঘাঁটিতে নিজে পৌঁছে ঘোষণা করেন সে কথা।
কিন্তু টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম তীরের একটি অংশ, যেখানে এই নদী মসুলকে দু’ভাগে ভাগ করছে, সেই ছোট্ট অংশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল জঙ্গিরা। কিন্তু সামনে বিপদ বুঝে টাইগ্রিস নদীতেই ঝাঁপ দেয় অনেকে।
শহর জুড়ে এখন যুদ্ধ শেষের বিধ্বস্ত ছবি। পুরনো শহরে পুরু কালো ধোঁয়ার জাল এখনও জানান দিচ্ছে ন’মাস ধরে কী টানাপড়েন চলেছে এখানে। রাস্তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে আইএস জঙ্গিদের লাশ। কোথাও কোথাও ইতিউতি এখনও শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ। আকাশপথেও নজরদারি চলছে সমানে। ইরাকি সেনার মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া রসুলের দাবি, টাইগ্রিস পেরোতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩০ জঙ্গি। পরে ইরাকি টিভি চ্যানেলে বলা হয়, টাইগ্রিস নদীতীরে মসুলের পুরনো শহরে জঙ্গিদের হটানো হয়েছে। উড়ছে ইরাকের পতাকা।
শুধু টাইগ্রিস তীরে ঝাঁপ দেওয়া নয়, আইএস জঙ্গিরা শেষ বেলায় সেনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে মহিলা আত্মঘাতী জঙ্গিদের। তাই এই চূড়ান্ত লড়াইয়ে হতাহতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, স্পষ্ট নয়। মানুষের প্রাণ যেমন গিয়েছে, তেমনই পরিকাঠামোগত দিক থেকেও ধুঁকছে মসুল। শহরের অসংখ্য পাথরের বাড়ি বিস্ফোরণে পুড়ে খাক। বিমান হানাতেও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বহু মানুষের আশ্রয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব অনুযায়ী, সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গত অক্টোবর থেকে ন’লক্ষ মানুষ গৃহহীন। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দাবি, আইএসের সঙ্গে লড়তে গিয়ে তাদের ক্ষতি হয়েছে ৪০ শতাংশ। যা পূরণ করতে এবং ইরাকি সেনাকে সমর্থন জুগিয়ে চলতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ২০১৮ সালের জন্য এই খাতে সরকারি বাজেটে ১২৭ কোটি ডলার বরাদ্দ করতে বলেছে।
এখনও আইএসের দখলে রয়েছে দক্ষিণের বেশ কিছু শহর এবং পশ্চিম মসুলের কিছু অংশ। সিরিয়ায় আইএসের স্বঘোষিত রাজধানী রাকাতেও বেশ চাপে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। ইরাক এবং সিরিয়া মিলিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার যে ডাক দিয়েছিলেন গোষ্ঠীর অন্যতম মাথা আবু বকর আল বাগদাদি, আজ সে সাম্রাজ্যে অনেকটাই ভাঙন ধরেছে।
ইরাকি সেনাকে আমেরিকা যে ভাবে সাহায্য করেছে, তাতে এখন পশ্চিমী দেশগুলোর উপরে আইএসের আঘাত নেমে আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা— বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তা ছাড়া আরও একটি সঙ্কট ভাবাচ্ছে বিশ্লেষকদের। ইরাকে মানবাধিকার সংক্রান্ত সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে কাজ করেন লিজে গ্রান্ডে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মসুলে সেনা অভিযান শেষ হচ্ছে, এটা বড় স্বস্তির বিষয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ মানেই মানুষের সঙ্কটে ইতি নয়। যাঁরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের হাতে আর কিচ্ছু নেই। আশ্রয় থেকে শুরু করে জল, খাবার, স্বাস্থ্য পরিষেবা সব অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের ব্যবস্থা করা দরকার। আর তার চেয়েও বড় কথা, ওই সব মানুষ মানসিক ভাবে অসম্ভব বিপর্যস্ত।’’
আপাতত বেশ হাল্কা মেজাজে ইরাকি সেনা। ২০১৪-য় উত্তর ইরাকে আইএসের দাপটে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিল তারা। এ বার এই জয়ে তারাও আত্মবিশ্বাসী অনেকটা। কেউ টাইগ্রিসে সাঁতার কেটে আনন্দ করছেন। কেউ মুখের ঘাম মুছছেন দেশের পতাকা দিয়ে। কিন্তু তারাও জানেন, সুখের সময় বেশি দিন নেই। যে গোষ্ঠী-সংঘর্ষের সুযোগ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়েছিল আইএস, আরব-কুর্দ বা শিয়া-সুন্নিদের এক দশকেরও বেশি সময়ের সেই জটিলতা এখনও মাথাব্যথা ইরাকি সেনার।