অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে দেশজোড়া প্রবল বিক্ষোভের মুখেও তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলেনননি। কিন্তু আজ বিলেতের মাটিতে সাংবাদিকদের চাঁছাছোলা প্রশ্নের মুখে কার্যত বাধ্য হলেন মুখ খুলতে। নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিলেন, ‘‘এই ধরনের যে কোনও ঘটনাতেই কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ কিন্তু সেই আশ্বাস ছাপিয়ে আজ যা বড় হয়ে দেখা দিল, তা হল বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর বেইজ্জতি। এর আগে ভারতের আর কোনও প্রধানমন্ত্রীকে এ ভাবে আক্রমণ করেনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। রাজপথে তুমুল বিক্ষোভের নজিরও বিশেষ নেই। কূটনীতিক মহলের অনেকেই বলছেন, দেশের সমস্যা দেশেই না-মিটিয়ে বিদেশে এসে মুখ পোড়ালেন নরেন্দ্র মোদী।
অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিতর্ক যে তিন দিনের ব্রিটেন সফরে মোদীর পিছু ছাড়বে না, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আগেই। মোদীর সফরের সময়ে বিক্ষোভের পরিকল্পনা ছকেছিল বিভিন্ন সংগঠন। পরিস্থিতি সামলাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলে ক্যামেরনের সরকার। আজ বিক্ষোভের নমুনা দেখেছে লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিট, ওয়েস্টমিনস্টার এলাকা। ডাউনিং স্ট্রিটে প্রতিবাদকারীদের হাতে মোদী-বিরোধী প্ল্যাকার্ডের সঙ্গে ছিল বিহার ভোটের ফলকে স্বাগত জানিয়ে বার্তাও। ব্রিটিশ রাজনীতিক জর্জ গ্যালোওয়ের নেতৃত্বে ‘আওয়াজ’ নামে মঞ্চ গড়ে সংঘবদ্ধ হন এই বিক্ষোভকারীরা। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন সলমন রুশদির মতো ২০০ বিশিষ্ট জন। মোদীর সঙ্গে বৈঠকে অসহিষ্ণুতা-প্রশ্ন তুলতে ক্যামেরনকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা।
ক্যামেরন মোদীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকে সেই প্রসঙ্গ তুলতেন কি না, জানা যায়নি। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে সরাসরি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের তিরের মুখে পড়েন মোদী। প্রথম প্রশ্নেই জানতে চাওয়া হয়, ভারত ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কেন?
অসহিষ্ণুতা বিতর্ক মাথাচাড়া দেওয়ার পরে ভারতে তেমন ভাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি মোদী। একান্ত সাক্ষাৎকারে দাদরির ঘটনার নিন্দা করেছেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে শুনিয়েছেন যে এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর দল বা সরকারের কোনও যোগ নেই। তবে শুধু দাদরি নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিচ্ছে, কেন অভিযোগের আঙুল উঠছে কেন্দ্রের শাসক দলের দিকেই, কেন অসহিষ্ণুতা সামাল দিতে তাঁর সরকারকে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না— এই সব প্রশ্নের জবাব মেলেনি তাঁর কাছ থেকে।
আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে সরাসরি প্রশ্নের সামনে পড়ে আর জবাব এড়ানোর উপায় ছিল না মোদীর। তিনি বলেন, ‘‘ভারত বুদ্ধ, গাঁধীর দেশ। আমাদের সমাজের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনও ঘটনা আমরা বরদাস্ত করি না। তা সে ঘটনা দেশের যে প্রান্তেই ঘটুক না কেন।’’ তাঁর দাবি, ১২৫ কোটির দেশে ক’জন এই ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন তা ভারত সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ধরনের যে কোনও ঘটনাতেই কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সংবিধান এক জন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গিকেও রক্ষা করার কথা বলে। তাঁর সরকার সেই সংবিধান মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।
তাতেও অবশ্য চুপ করেনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। প্রশ্ন উঠেছে, ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা নিয়েও। তাঁর সামনেই ক্যামেরনকে ব্রিটিশ সাংবাদিক বলেছেন, মোদীর ব্রিটেনে আসার উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা হলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হল কেন? ক্যামেরন জবাব দেন, বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ভারতে ক্ষমতায় এসেছেন মোদী। তাই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। আর মোদীর জবাব, ব্রিটেনে আসা নিয়ে তাঁর ওপর কখনওই কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
এমনকী, ২০০৩ সালেও ব্রিটেনে এসে যে সাদর অভ্যর্থনাই পেয়েছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। তার পরেও আর এক ব্রিটিশ সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন, বিশ্বের সব চেয়ে বড় গণতন্ত্রের নেতা সাধারণত যে সম্মান পান, তা কি মোদীর পাওয়া উচিত?
গুজরাত দাঙ্গার পরে মোদীকে ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আমেরিকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সে দেশে গিয়ে বিপুল অভ্যর্থনাই পেয়েছেন মোদী। ম্যাডিসন স্কোয়ারে তাঁর জনসভায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরবেও ছিল একই ছবি। মোদী প্রথম ধাক্কা খেলেন এই ব্রিটেনে এসে। এবং সেই দায় তাঁর নিজেরই, বলছেন কূটনীতিক মহলের অনেকেই। তাঁদের মতে, বিহার ভোটের দিকে তাকিয়েই অসহিষ্ণুতা, গো-হত্যার বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন মোদী। বিজেপির রণকৌশল ছিল মোদী উন্নয়নের কথা বলবেন আর নিচুতলার নেতারা মেরুকরণের রাজনীতি করবেন। কিন্তু সেই চেষ্টা বিহারে সফল হয়নি। বিজেপি গো-হারা হেরেছে। একই সঙ্গে নড়বড়ে করে দিয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রনেতা হিসেবে মোদীর অবস্থান। আজ কোনও রকম পক্ষপাতিত্ব না-করে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েও যা পুনরুদ্ধার করা শক্ত বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত।
ভারতে মোদীর বিরোধীরা ইতিমধ্যেই তাঁর আশ্বাস সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন বটে, কিন্তু তা নেওয়া হচ্ছে কোথায়? দাদরি-সহ কোনও ঘটনাতেই তো এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। আজও টিপু সুলতান-বিতর্ক নিয়ে মুখ খোলায় নাট্যকার-অভিনেতা গিরিশ কারনাডকে টুইটারে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ শুধু বিদেশে মুখরক্ষা করতে কথার কথা ছাড়া কিছু নয়। কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মার কথায়, ‘‘দেশে থাকার সময়ে কি মোদী ভুলে যান যে, এটা বুদ্ধ ও গাঁধীর দেশ?’’ তাঁর দাবি, ‘‘আসলে মোদী দু’টি মুখ নিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। বিদেশে গিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক মুখটি তিনি লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। কিন্তু বিদেশের শিক্ষিত সমাজের বড় অংশ ও সংবাদমাধ্যমও বিজেপির সাম্প্রদায়িক মুখের কথা জেনে ফেলেছে।’’ কংগ্রেস সূত্রে খবর, ব্রিটেনে সাংবাদিক বৈঠকে মোদী অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়ায় উৎসাহিত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। আগামিকালই সাংবাদিক বৈঠক করে ফের আক্রমণ শানাতে পারেন দলীয় নেতারা।
মোদী-বিরোধী বিক্ষোভ লন্ডনের রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র।
বিজেপি শিবিরের অবশ্য দাবি, বিরোধীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মিথ্যা প্রচার করছেন। রাষ্ট্রপতি শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা মেনে চলার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তা ছাড়া দাদরি থেকে কালবুর্গী হত্যা— কোনও ঘটনাতেই কেন্দ্রীয় সরকার জড়িত নয়। ইচ্ছে করেই এই ঘটনাগুলোতে মোদীর নাম জড়ানো হচ্ছে।
ক্যামেরনের সঙ্গে সাংবাদিক বৈঠকের পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বক্তৃতায় আর অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ তোলেননি মোদী। সেখানে তাঁর মূল বিষয় ছিল সন্ত্রাস। তাঁর সেই বক্তৃতা এবং বিলেত সফরের প্রাপ্তি, যেমন, ৯০ হাজার কোটি পাউন্ডের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইত্যাদি, ফলাও করে ব্যাখ্যা করেছে বিদেশ মন্ত্রক। কিন্তু অস্বস্তির বাতাবরণ তাতে চাপা পড়েনি।
লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিদ্রোহের বোঝা কাঁধে নিয়ে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন মোদী। শান্তি মিলল না সেখানেও!
বললেন নেহরুর কথাও
আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে সম্মেলনে জওহরলাল নেহরুর কথা বলেননি মোদী। কিন্তু আফ্রিকার একের পর এক নেতা ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কে নেহরুর অবদানের কথা বলে অস্বস্তিতে
ফেলেন তাঁকে। কিন্তু সে ভুল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে করলেন না প্রধানমন্ত্রী। জানালেন, অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আধুনিকতার রূপকার ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানেই তাঁদের লক্ষ্যের কথা প্রথম বুঝতে পারেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জওহরলাল নেহরু ও মনমোহন সিংহ।