হামলাস্থলে বার্লিনের মেয়র মিখায়েল ম্যুলার, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল, অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী টমাস ডি-মাইজিয়ের। ছবি: রয়টার্স।
উৎসবের শহরে ফের সন্ত্রাসের অন্ধকার!
সোমবার রাতে বার্লিনের একটি জমজমাট বড়দিনের বাজারে ঢুকে পড়া একটি লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। পুলিশ এর পিছনে জঙ্গিযোগের আঁচ পেলেও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনও গোষ্ঠী হামলার দায় নেয়নি। পাশাপাশি, ওই লরি চালকের গ্রেফতারি এবং পরিচয় নিয়ে এক প্রস্থ চাপানউতোর
চলল মঙ্গলবার দিনভর! প্রথমে ওই লরিটির চালক মনে করে ২৩ বছরের এক পাকিস্তানি শরণার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। তবে দফায় দফায় জেরার পরে ভুল লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সন্দেহ তৈরি হয় পুলিশের অন্দরেই! রাতের দিকে পুলিশের ওয়েবসাইটে ভুল গ্রেফতারির খবর প্রকাশ করা হয়। ছেড়ে দেওয়া হয় নাভেদ নামে ওই পাকিস্তানি শরণার্থীকে।
বার্লিন-হামলার অবিকল একই ধাঁচে গত ১৪ জুলাই ফ্রান্সের নিসে বাস্তিল দিবসের ভিড়ে লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৮৬ জনের! সেই ঘটনার দায় নিয়েছিল ইসলামিক স্টেট। এ বারও সেই আদলের হামলায় জঙ্গি-যোগের সন্দেহই যে সামনে আসছে, মেনে নিয়েছেন খোদ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল। প্রাথমিক ভাবে পোলান্ডের নম্বরপ্লেট লাগানো ওই লরির চালককে পোলান্ডের নাগরিক বলে সন্দেহ করেছিল পুলিশ। পরে জানা যায়, লরি চালাচ্ছিল ২৩ বছরের নাভেদ নামে এক পাকিস্তানি শরণার্থী। তবে রাতের দিকে ফের পুলিশ জানায়, ভুল লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘আমরা ভুল লোককে ধরেছিলাম। তাকে ছেড়ে দেওয়টা হয়েছে। আসল অপরাধী এখনও সশস্ত্র এবং ফের হামলা চালাতে পারে।’’
পুলিশ জানিয়েছে, গত কাল স্থানীয় সময় রাত আটটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র কাইজার উইলহেল্ম মেমোরিয়াল গির্জা এবং তার পাশের ব্রাইটশাইডপ্লাৎজ এলাকায় শুধু স্থানীয়রাই নন, ভিড় জমিয়েছিলেন পর্যটকেরাও। সেই ভিড়ে ঢুকে পড়ে দ্রুতগতিতে আসা লরিটি। অন্তত ৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে মানুষজনকে পিষে দিয়ে এগোতে থাকে লরি। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয় জনতা। শুরু হয় ছোটাছুটি। লরির তাণ্ডবে ভেঙে পড়ে কয়েকটি অস্থায়ী দোকানও। পুলিশের দাবি, লরির চালকের কেবিনে দু’জনকে দেখা গিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে প্রায় ৮০ মিটার এগোনোর পরে দাঁড়িয়ে পড়ে লরিটি। লাফিয়ে নেমে চম্পট দেয় চালক। পরে ওই লরির চালক সন্দেহে পাকিস্তানি যুবক গ্রেফতার হয়। লরির মধ্যে পোল্যান্ডের এক বাসিন্দার দেহ মিলেছে। পুলিশের ধারণা, আরিয়াল জুরাওস্কি নামে ওই মৃত ব্যক্তিই লরিটির আসল চালক। সম্ভবত লরি ছিনতাই করে তাকে খুন করা হয়েছে।
বার্লিনের মেয়রকে সঙ্গে নিয়ে এ দিনই হামলাস্থলে যান মের্কেল। আহত ও মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত আমরা যা জানতে পেরেছি, তাতে এই ঘটনাকে জঙ্গিহানা বলেই মনে করা হচ্ছে।’’ যে জার্মানি এত দিন শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে খেলনা-লজেন্স-জামাকাপড়-খাবার নিয়ে স্টেশনে ভিড় জমিয়ে এসেছে, সেখানেই এমন জঙ্গিহানা এবং তাতে এক শরণার্থীর নাম জড়ানোয় স্বাভাবিক ভাবে উদ্বেগের পারদ চড়েছে। মের্কেলও বলেছেন, ‘‘আমি জানি, যদি সত্যি জার্মানির কাছে আশ্রয় চাওয়া কোনও শরণার্থী এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, সেটা মনে নেওয়া আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন।’’
অনেকে মনে করছেন, একেবারে নিসের আদলেই বার্লিনের ঘটনাটিও ঘটিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনও ‘লোন উলফ’ সমর্থক! নিসের হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও তদন্তে ধৃতের জঙ্গিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সেই সময় থেকেই ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়দার মতো জঙ্গিগোষ্ঠী ‘নিঃসঙ্গ সমর্থক’দের ভিড়ের মধ্যে লরি নিয়ে হামলার নির্দেশ দিয়েছিল।
এ দিন বার্লিনের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী টমাস ডি-মাইজিয়ের জানিয়েছেন, এই ঘটনায় উৎসবের মরসুম ধাক্কা খেলেও দেশের অন্য সব বড়দিনের বাজার খোলা রাখা এবং উদ্যাপন বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তাঁর কথায়, ‘‘এই হামলার পিছনে যা-ই কারণ থাক না কেন, এর জন্য আমরা কিছুতেই স্বাধীন জীবনধারণ থেকে সরে আসব না।’’