Ali Cobby Eckermann

‘প্রকৃতিকে বাঁচাতে পারেন ভূমিসন্তানেরাই’

Advertisement

সীমন্তিনী গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২০ ০৬:২৭
Share:

বছরের প্রথম সূর্য। (বাঁ দিকে) ১ জানুয়ারি ভিক্টর হারবার থেকে তোলা সূর্যোদয়ের ছবি। (ডান দিকে) আলি কবি একারম্যান।

বছরের প্রথম সূর্য দেখে চমকে উঠেছিলেন ভিক্টর হারবারের বাসিন্দা রোজ় ফ্লেচার। আকাশের নীচের দিকটা লাল, ওপরটা কালো। আর মাঝখানে হলুদ রঙা সূর্য। সূর্যোদয়ের এমন চেহারা আগে না-দেখলেও ছবিটা রোজ়ের খুব পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের পতাকার চেহারাটা যে এ রকম-ই! মোবাইল-ক্যামেরায় সেই দৃশ্য বন্দি করেন রোজ়। তার পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিটা পোস্ট করে লেখেন— ‘বর্ষবরণের সূর্যোদয় কি আমাদের দেশের আদিবাসিন্দাদের কাছ থেকে কোনও বার্তা বহন করে আনল? তাঁদের কাছ থেকে প্রকৃতি-রক্ষার পাঠ আমরা গ্রহণ করিনি বলেই কি আজ এই সর্বনাশ?’

Advertisement

রোজ়ের সেই ছবি ও পোস্টের পর থেকেই প্রশ্নটা ঘুরছে অনেকের মনে। দেশের যাঁরা আদি বাসিন্দা, সেই ভূমিসন্তানদের কাছ থেকে পরিবেশ সচেতনতার পাঠ নিলে কি এই বিপর্যয় এড়ানো যেত? প্রশ্নটা শুনে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল আলি কবি একারম্যানের মুখে। আনন্দবাজারের সঙ্গে ভিডিয়ো চ্যাটের অপর প্রান্ত থেকে বললেন, ‘‘হাজার হাজার বছর ধরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ। আড়াইশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন সব কিছু ধ্বংস করে দিল। এই দাবানল সেই ধ্বংসেরই প্রতীক!’’

আলি কবি একারম্যান অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক। তাঁর শিকড় অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলের ইয়াংকনজারা গোষ্ঠীতে। তবে লেখালেখি করেন মূলত ইংরেজিতেই। বছর ৫৭-র আলির সঙ্গে কথা হচ্ছিল সে দেশের সাম্প্রতিক দাবানল তাণ্ডব নিয়ে। আলির মতে, ‘‘ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে ভাবে ধ্বংস শুরু করেছিল, এখনও সে পথেই চলেছে সরকার। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের নানা ভ্রান্ত নীতি। অর্থনীতিকে ‘জোরদার’ করতে গিয়ে তিনি প্রকৃতির সর্বনাশ ডেকে আনছেন।’’

Advertisement

সেপ্টেম্বর থেকে জ্বলছে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া। দাবানলের প্রকোপে সিডনির আকাশ কখনও ছাইয়ে ঢেকে গিয়েছে। কখনও বা সিডনি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরের শহর নিউক্যাসেলের আকাশ গনগনে লাল। ইতিমধ্যেই পুড়ে খাক আড়াই কোটি একর জমি, মৃত অন্তত ১০০ কোটি বণ্যপ্রাণী। মারা গিয়েছেন দমকলকর্মী-সহ অন্তত ২৩ জন। গৃহহীন দশ হাজারেরও বেশি। একশোটা বড় মাপের দাবানল জ্বলছে এখনও।

এই পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের পতাকায় আকাশের সেজে ওঠাকে ‘বিশেষ বার্তা’ বলেই মনে করছেন আলি। বললেন, ‘‘আমরা, দেশের আদি বাসিন্দারা, যে সত্যিই ‘ভূমিসন্তান’, প্রকৃতিকে রক্ষা করতে জানি, সেই বার্তা-ই দিয়েছিল সেই তে-রঙা আকাশ। বাঁধনছাড়া খনন কাজ ও গাছ কাটার মাসুল দিতে হচ্ছে আমাদের। সব থেকে দুঃখের— মাসুল দিতে হচ্ছে পশুপাখি, গাছপালাকেই। কত বিভিন্ন প্রজাতি এই দাবানলে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেল!’’

আলির মতে, ‘‘অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মকালে এই ধরনের ‘বুশফায়ার’ বা দাবানল নতুন কিছু নয়। জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছের তলায় যে ছোটছোট ঘাস জন্মায়, তাপপ্রবাহে সেখান থেকেই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিসন্তানেরা জানতেন, কী ভাবে ঠিক গরমের আগে সেই ঘাস অল্প অল্প পুড়িয়ে দাবানলের প্রকোপ কমানো যায়। কতটা আগুন দিলে ঘাসটুকু পুড়ে যাবে কিন্তু আগুন ছড়াবে না, সেই জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল তাঁদের। কিন্তু আমরা সেই জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করিনি, সেই দক্ষতাও অর্জন করিনি। ফলে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।’’ আলি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘গত বছর আমাজন বৃষ্টি বনানী যখন দাবানলে ধ্বংস হচ্ছিল, সে দেশের ভূমিসন্তানেরাও বলেছিলেন, ‘আমাদের অরণ্য আমাদের ফিরিয়ে দাও। আমরাই তাকে রক্ষা করব।’ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো-ও বাঁধনছাড়া খননকাজ চালিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করছেন।’’

এখন কি আর বাঁচার কোনও উপায় আছে? আলি মনে করেন, ‘‘প্রকৃতির উপর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে, এমন যে-কোনও সরকারি সিদ্ধান্তে আদিবাসীদের মতামত নেওয়া দরকার।’’ সম্প্রতি আমাজন অরণ্য রক্ষায় ভূমিপুত্রদের গুরুত্ব নিয়ে সরব হয়েছিল সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ। অস্ট্রেলিয়ার কয়লা খনিতে খনন কাজ বন্ধ করতেও একাধিক বার আর্জি জানিয়েছে সে। সেই প্রসঙ্গ তুলে আলির প্রশ্ন, ‘‘একটা বাচ্চা মেয়ে যদি পরিবেশ রক্ষায় ভূমিসন্তানদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং সাহস করে মুখ খুলতে পারে, তা হলে আমরা চুপ করে থাকব কেন?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন