বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশে বিক্ষুদ্ধ জনতার ভিড়। — ফাইল চিত্র।
ঠিক সময়ে খবর পেলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন! বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দীপুচন্দ্র দাসকে পিটিয়ে খুনের পর দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এমনটাই জানাল সে দেশের পুলিশ। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ১২ জন। র্যাব জানিয়েছে, ওই যুবক উস্কানিমূলক কোনও মন্তব্য করেছিলেন, এমন প্রমাণ এখনও মেলেনি। বছর ২৭-এর দীপু যে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন, সেখানকার শ্রমিক এবং স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেই রাতে?
ময়মনসিংহের শিল্প পুলিশ সুপার মহম্মদ ফারহাদ হোসেন খান সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডেলি স্টার’কে জানিয়েছেন, রাত ৮ টার দিকে একজন সহকারী সাব-ইনস্পেক্টর তাঁকে ঘটনাটি সম্পর্কে জানান। ওই কারখানা থেকে তাঁদের দফতর প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, তবে ভালুকা থানা ও ঘটনাস্থলের দূরত্ব তুলনায় কম। ফারহাদের কথায়, ‘‘আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হই। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় কয়েকশো মানুষ ছিল। বিশাল ভিড় ঠেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছোনো খুব কঠিন ছিল। যখন আমরা কারখানার গেটে পৌঁছোই, তখন দেখি উত্তেজিত জনতা মরদেহটি প্রায় দু’ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’’ এর জেরে ওই রাস্তায় পরবর্তী প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট।
ফারহাদের কথায়, ‘‘ঠিক সময়ে ফোন করলে হয়তো দীপুর প্রাণ বাঁচানো যেত, কিন্তু ফোন আসেনি।’’ এসপি-র আরও অভিযোগ, কারখানার কোনও কর্তা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ভালুকা মডেল থানার ওসি মহম্মদ জাহিদুল ইসলামও বলছেন, ঘটনার সূত্রপাত যখন, সে সময় পুলিশে খবর দিলে হয়তো ওই শ্রমিককে উদ্ধার করা যেত। কিন্তু তাঁরা শেষ মুহূর্তে খবর পান।
ভালুকার জামিরদিয়ায় অবস্থিত ওই কারখানার সিনিয়র ম্যানেজার সাকিব মাহমুদ অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তিনি ডেলি স্টার-কে জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা নাগাদ একদল শ্রমিক কারখানার ভিতরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন দীপু। খবর পেয়ে কারখানার কর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে কারখানার ম্যানেজার আলমগির হোসেন দীপুকে ‘ভুয়ো পদত্যাগপত্রে’ সই করতে বলেন। তার পর নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই যুবককে কারখানার একটি ঘরে বসিয়ে রাত ৮টা নাগাদ পুলিশে খবর দেওয়া হয়। ততক্ষণে অবশ্য খবর কারখানার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে জড়ো হয়েছেন শয়ে শয়ে মানুষ। রাত ৮টা ৪৫ মিনিট নাগাদ উত্তেজিত জনতা কারখানার গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে দীপুকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসেন। যোগ দেন স্থানীয়েরাও। গণধোলাইয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দীপুর। এর পর দেহটি গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে।
রবিবার সকালে র্যাব জানিয়েছে, দীপু সমাজমাধ্যমে বা প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক কোনও কথা বলেছিলেন, এমন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তদন্তে নেমে প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে র্যাবের আধিকারিকেরা জেনেছেন, সে দিন উপস্থিত জনতার কেউই দীপুকে উস্কানিমূলক কিছু বলতে নিজ কানে শোনেননি। বেশির ভাগেরই দাবি, তাঁরা অন্যের মুখে বিষয়টি শুনেছিলেন। রবিবার ওই ঘটনায় মুখ খুলেছে ভারত। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। দীপুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’’
ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের ওই বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক। তাদের দাবি, ময়মনসিংহের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ভারতের কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বলে দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশে একজন নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ইউনূসের বিদেশ মন্ত্রকের আরও দাবি, ময়মনসিংহের ঘটনায় তারা দ্রুত পদক্ষেপ করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।