উৎসবের আনন্দ নাকি শব্দবাজির তাণ্ডব? আলোর উৎসব কবে থেকে ‘শব্দের উৎসব’-এ পরিণত হল?- এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দুর্বিষহ অবস্থা সাধারণ মানুষের তো বটেই, বিশেষ করে পোষ্যদের অভিভাবকদের। বাজির কানফাটানো আওয়াজ ও আগুনের ঝলকানি যেন আতঙ্ক হয়ে উঠছে বাড়ির পোষ্য তথা রাস্তার সারমেয়দের। এই আতঙ্কে তাদের হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আর নতুন কোথায়? তবে শুধুই কি পশু? বাড়ির নবজাতক, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বাইরের পাখি এমনকি গাছেরাও কি কম ভুক্তভোগী?
আনন্দবাজার ডট কমকে তথাগত মুখোপাধ্যায় বলেন, “মানুষ তো বোধ হয় ভুলেই গিয়েছেন যে উদ্ভিদেরও প্রাণ রয়েছে। আলোর উৎসবে গাছেদের গায়ে যে আলো লাগানো হয়, তাতে কিন্তু তাদের বেশ কষ্ট হয়। গাছে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, বোম ফাটানো-এগুলি কি করা উচিত? দীপাবলি কি কোনওদিন শব্দের উৎসব ছিল? আমরা তো আলোর উৎসব বলেই চিনতাম। হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল কেন?” অভিনেতা তথা পরিচালকের কথায়, “এগুলি আসলে পারিবারিক শিক্ষার প্রতিফলন। কে কত বড় বোম ফাটাতে পারে, এটাও নাকি দেখনদারির বিষয়! এর চক্করে আমরা এটা ভুলে যাই যে যতটা জোরে একটা আওয়াজ আমাদের কানে আসে, বেড়াল, কুকুর অথবা অন্যান্য পশুরা তার আট থেকে দশ গুণ জোরে সেটা শুনতে পায়। ওদের শ্রবণশক্তি অনেক বেশি। একটা চকলেট বোমের আওয়াজে আমরা মানুষেরাই যখন চমকে যাই, তা হলে ওদের অবস্থাটা কী হয়, সেটা এক বার ভাবা উচিত।” একই সুর শ্রীলেখা মিত্রের কণ্ঠেও। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ডেসিবেলের আওয়াজ বেঁধে দেওয়া হলেও আমার মনে আছে, গত বছর প্রচণ্ড বাজি ফেটেছিল। শুধু আওয়াজ কেন, দূষণের কারণেও প্রচুর পাখি মারা যায়। উপরন্তু রাতবিরেতে তারস্বরে গানের আওয়াজ! এই পুরো পৃথিবীটা যে শুধু আমাদের একার, মানুষের এই ধারণাটা ভুল। নবজাতক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও একটু শান্তির প্রয়োজন। উৎসবের নামে অন্যকে কষ্ট দেওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে আসে পশুবলির কথাও।”
সচেতনতা কি আদৌ বেড়েছে? তথাগত বলেন, “সচেতনতা বাড়লেও আইন যদি পদক্ষেপ না করে তা হলে কী হবে? কিছু কিছু এলাকায় পুলিশ সক্রিয় অবশ্যই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ বহু অবাঙালি বিয়ের শোভাযাত্রাতেও বাজি ফাটতে দেখেছি। সবার আগে নিজেদের সক্রিয় হতে হবে। শব্দবাজি ফাটানো যাবে না।” শ্রীলেখা বলেন, “বিভিন্ন নামী সংস্থার ফ্যাশনের অনুষ্ঠানে পশুর রোমের তৈরি পোশাককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরাও এমন ছোট্ট একটা পদক্ষেপ করতে পারব না?” অত্যন্ত বিরক্তির সুরেই নায়িকা যোগ করেন, “জন্তুদের সঙ্গেও আমাদের তুলনা করা যায় না। ওরা আসলে অনেক ভাল আমাদের থেকে। জঙ্গলের নিয়মে পশুরা অন্য পশুদের হত্যা করে নিজেদের খাদ্যের তাগিদে। কিন্তু এখানে অনেক বাচ্চারা আছে, যারা বিনা কারণে কুকুরের লেজে কালীপটকা বেঁধে দেয় শুধুমাত্র নিজেদের বিনোদনের জন্য। এটা কোন ধরনের মানসিকতা?” এই প্রসঙ্গেই বলা হয়, এক বছর আগে ঠিক এমনই অরাজকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্রও। বিকেল গড়াতেই বাড়ির সামনে ব্যান্ড পার্টির বাজনায় নাজেহাল হয়েছিলেন তিনি। ছটফট করে কাঁপছিল বাড়ির পোষ্য। তাঁর কথায়, “এই সময়ে পশুপাখিরা একটা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। এই আওয়াজ তারা সহ্য করতে পারে না।”
তা হলে কী করণীয় এ ক্ষেত্রে? রূপাঞ্জনা বলেন, “আমার বাড়ির পোষ্যদের একটি শব্দনিরোধক ঘরে রাখি। একসঙ্গেই থাকে ওরা। যাঁদের একটু সামর্থ্য আছে, তাঁরা এ ভাবেও খেয়াল রাখতে পারেন। আর আমি এখন থেকেই ধীরে ধীরে ওদের দুমদাম আওয়াজের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলছি। যাতে কালীপুজোর সময়ে হঠাৎ ভয় না পেয়ে যায়। কিন্তু পাশাপাশি মানুষকেও অনুরোধ করা দরকার। বাজি ফাটানোর আগে মানুষ যেন একটু ভাবনা-চিন্তা করেন। নিজেদের আনন্দ যেন অন্যদের দুঃখ না হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকেই নিজেদের মধ্যে বদল আনতে হবে। ক্রমাগত কানের সামনে বলে যেতে হবে আনন্দের নামে রাস্তার কুকুর, বিড়াল, পাখি-কারও-ই ক্ষতি করলে চলবে না।”
শ্রীলেখারও বক্তব্য একই। তিনি নিজেও পাঁচ সারমেয় সন্তানের মা। অভিনেত্রী বলেন, “কালীপুজো-দীপাবলির ক’টা দিন ঘরের দরজা-জালনা বন্ধ করে ওদের সঙ্গেই থাকি। হালকা কিছু গান চালিয়ে রাখি। যাতে ওদের মনটা অন্যদিকে ব্যস্ত রাখা যায়। কোথাও যাই না ওদের ছেড়ে।” যদিও এই সমস্যা নিয়ে কম ভুগতে হয়নি তাঁকে। শ্রীলেখা বলেন, “আমি যে আবাসনে থাকি, সেখানে আমার সঙ্গে এই পশু-পাখি নিয়েই বহু কথা কাটাকাটি হয়েছে এক পরিবারের। এক বার এই আবাসনে প্রায় ষাট বস্তা বাজি ফেটেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পুলিশে খবর দিয়েও কোনও লাভ হয়নি।” রূপাঞ্জনা বলেন, “আমিও আমার লোকাল থানাতে জানিয়ে রাখব। তবে এ ক্ষেত্রে ক্লাবগুলিকেও এগিয়ে আসতে হবে। সংগঠন করে প্রতিবাদ না করলে হবে না।” তথাগতর কথায়, “সোশ্যাল মিডিয়া নিজেদের বক্তব্য রাখার অন্যতম মাধ্যম। যাঁরা এই ধরনের নির্মম কাজ করছেন, তাঁদের তৎক্ষণাৎ ভিডিয়ো করে সমাজমাধ্যমে ছেড়ে দিতে হবে। যাতে সর্বসমক্ষে এই সমস্ত অপরাধীদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলা যায়। যে দেশে আইন দুর্বল, সেখানে নাগরিকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।”
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।