রাজসিক দুর্গা এবং তামসিক কালীর পর হেমন্তে দেবী হৈমবতীর অর্থাৎ জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় মেতে উঠেছে গোটা বাংলা। মনসার ক্ষেত্রে যেমন চাঁদ সওদাগর, জগদ্ধাত্রীর ক্ষেত্রে তেমনই কৃষ্ণচন্দ্র রায়। নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায়-ই বাংলায় দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজোকে জনপ্রিয় করেন। তাঁর হাত ধরে দিকে দিকে শুরু হয় দেবী হৈমবতীর আরাধনা। প্রচলিত ইতিহাস বলে, বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সত্যিই কি তাই?
মসনদে তখন মীর কাশিম। পলাশির যুদ্ধ দেখে ফেলেছে বাংলা। ১৭৬২-৬৩ সাল, রাজস্ব না-দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্রকে বন্দি করলেন মীর কাশিম। মুঙ্গেরে পাঠানো হল তাঁদের। তার পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন কৃষ্ণচন্দ্র। ফেরার পথে নৌকায় তাঁর মন খারাপ। আশ্বিন পেরিয়ে গেল, দুর্গার আরাধনা হল না! রাজার মন বিষাদে ডুবে। তখনই স্বপ্নে এক যোদ্ধাবেশী দেবীর দর্শন হল কৃষ্ণচন্দ্রের। দেবী রাজাকে তাঁর পুজো করার নিদান দিলেন। বলেও দিলেন পরের মাসে শুক্ল পক্ষে পুজো করতে হবে। পণ্ডিতদের বিধান নিয়ে রাজা সেই মতো দেবীর পুজোর আয়োজন করলেন। শুরু হল জগদ্ধাত্রী পুজো। এ কাহিনি যুগ যুগ ধরে শুনে আসছে বাংলা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর বয়স ২৫০-২৭০ বছর। কিন্তু পাঁচশো বছরের প্রাচীন লিখিত পুঁথিতে দেবীর উল্লেখ রয়েছে। এমনকী বাংলার নানা প্রাচীন মন্দিরের গাত্রে জগদ্ধাত্রীর মূর্তিও খোদিত রয়েছে। এগুলিই প্রমাণ করে, অনেক কাল ধরে বঙ্গে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজোর প্রচলন ছিল।
মায়াতন্ত্রে দেবী জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ আছে। বৃহঃস্পতি রায়মুকুটের ‘স্মৃতি রত্নহার’, মহামহোপাধ্যায় শূলপাণির ‘ব্রত কালবিবেক’, আচার্য শ্রীনাথ চূড়ামণির ‘কৃত্যতত্ত্বার্ণব’ ইত্যাদি গ্রন্থে বাংলার নানান স্থানে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ আছে। উল্লেখ রয়েছে পুজোর তিথির। এদের কোনওটি ষোড়শ শতকে লেখা, কোনওটি পঞ্চদশ শতকে রচিত। অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্রের বহু আগে থেকে যে বঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ছিল; তার প্রমাণ এই রচনাগুলি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও আছে। পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর প্রস্তরমূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।
এ ছাড়াও মুর্শিদাবাদের বড়নগরের চার বাংলা মন্দির, বীরভূমের ইলামবাজারের রত্নেশ্বর শিব মন্দিরের গাত্রে জগদ্ধাত্রী আছেন। নদিয়া জেলার প্রাচীন দুই মন্দিরের গাত্রে জগদ্ধাত্রীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দিরের গাত্রে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি রয়েছে। নদিয়ারাজ রুদ্র রায়ের স্ত্রী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়, কেউ কেউ আবার বলেন নদিয়ারাজ রাঘব রায় জলেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। দিগনগরে রয়েছে রাঘবেশ্বর শিবমন্দির, ওই মন্দিরের গাত্রেও জগদ্ধাত্রীর মূর্তি দেখা যায় হয়। ১৬৬৯ সাল নাগাদ মহারাজা রাঘব রায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। রাঘব রায় ও রুদ্র রায় দু’জনেই কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। অর্থাৎ নদিয়ার রাজপরিবারের সঙ্গে প্রাককৃষ্ণচন্দ্র আমল থেকে জগদ্ধাত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
আরও পড়ুন:
বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলিত ছিলই। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের কৃতিত্ব হল তিনি জগদ্ধাত্রী পুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ব্রাহ্মণের আরাধ্যা দেবীকে রাজকীয় স্বীকৃতি দেন। রাজবাড়ির ঠাকুরদালান থেকে দেবীকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেন। সর্বজনের দেবীতে পরিণত করেন। রাজা পুজো করলে তবেই আমজনতা পুজো-উৎসবে মাতবে। রাজার ঈশ্বরই প্রজার অধিশ্বর। বন্দি হওয়া, গ্রেপ্তারি ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে সমসময়ের চর্চাকে আড়াল করতে, প্রজার মন থেকে রাজার দুর্দিনের স্মৃতিকে ঢেকে দিতে কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পুজোকে ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে হয়, যা প্রমাণ করে প্রশাসক কৃষ্ণচন্দ্রের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।